একটা মহিমান্বিত কাজ

এক জন্মদানবিরোধী
0

 



 বাবার সাথে ঈশ্বরের (ধর্মগ্রন্থগুলোর কল্পিত ঈশ্বর) বড় মিলটা হলো -

ঈশ্বর আমাদের (আমরা না চাইতেই, নিজের খেয়াল খুশিমত) সৃষ্টি করে নিজেকে বিশাল কিছু ভাবে। তেমনি বাবারাও জন্ম দিয়ে ভাবে, কী একটা মহিমান্বিত কাজ করে ফেলেছে!

"এরচেয়ে ভালো হতো না কিছু, 

যদি না হতো কভু জনম আমার।

তারপরে ভালো হতো যদি জনমের পরে দেরি না করে ফিরে যেতাম আবার!

কেননা যৌবনের নেশা কেটে গেলে,  জীবন আটকে পড়ে যন্ত্রণার জালে। 

যন্ত্রণা, যন্ত্রণা কেবলই যন্ত্রণা;

এই চক্র থেকে কারোরই কি মুক্তি মেলে?"

- সফোক্লিস 

 

জন্ম, অর্থহীন জীবন, খাওয়া, ঘুম, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া, সেক্স, শনি-রবি-সোম গোনা,  সবুজ ঘাস, উঁচু পাহাড়,  নীল জলের সমুদ্র দেখে জীবন সুন্দর বলা, সবশেষে মৃত্যু!

এসবেরই পুণরাবৃত্তি করানোর জন্য বাবাদের ভূমিকা অপরিসীম! ( অন্তত তাদের এত মহিমান্বিত করানোর মত কিছুই না তারা) 

 

তারা আমাদের জন্ম দেয়, আমরা আবার সন্তানদের জন্ম দেই! চলতেই থাকে...... 

তারা যেমন আমরা না চাইতেই,  আমাদের অনুমতি না নিয়ে,  জোর করে জীবন চাপিয়ে দিয়ে, মৃত্যু অবধারিত জেনেও জন্ম দিয়ে বলে,  'দেখো!  তোমাদের কত কষ্ট করে জন্ম দিয়েছি ( কী একটা করে ফেলছে! পুরাটাই নিজেদের স্বার্থে!  নিজের জিন অমর করার তাগিদ, বৃদ্ধ বয়সের আশ্রয়)  কত্ত কষ্ট করছি তোমাদের জন্য,  আবার আমরাও জন্ম দিই এসবই বলি!

'দি মিথ অফ সিসিফাস' বইয়ের (কাম্যুর লেখা) সিসিফাসের মত করে অর্থহীন জীবনকে ভ্রমে অর্থপূর্ণ ভাবছি!  সিসিফাস যেমন দেবতাদের দ্বারা অভিশপ্ত ছিলো আমরাও তাই। 

এসবের পুণরাবৃত্তি করানোর জন্য জন্ম দেবার আগে একবার থামি,  ভাবি,  প্রশ্ন করি! 

 

সমাজে, বিদ্যাপীঠে, পুস্তকে মা-বাবা নিয়ে নীতিবাক্যের ছড়াছড়ির চাপে  তাদেরও যে কিছু চিন্তাধারা কিংবা সন্তান লালনের পদ্ধতির পরিমার্জন দরকার সেটা ভাবনাতেও আসেনা। 

ছাগল পালনের আগেও আমরা একটু জানি, পড়াশোনা করি ছাগল পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে! 

সন্তান জন্ম দেবার আগে কিছু মানুষদের ঘাড় ধরে বাবা এবং মা শব্দের মানে নতুনভাবে শেখানো উচিৎ। 

যদিও  একজন নারী এবং পুরুষের শরীরের চাহিদাই এখানে মূখ্য, মা কিংবা বাবা হবার একটা গুপ্ত লালসা থাকে নারী - পুরুষের মাঝে তবুও এই কার্যকলাপের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় নতুন এক ব্যাক্তি।  যে একজন স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন সত্তা। তাই তখন আর ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না।

 

ওরিয়ানা ফাল্লাচির লেখা "লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন" বইটা পড়ে আমি অনেকটা সময় বাকরুদ্ধ ছিলাম।

মায়ের আত্মকথা সেখানে পড়েছি আমরা কিন্তু আমি পাশাপাশি সন্তানের আত্মকথাও ভাবছিলাম।

তিনি তাঁর লেখায় সমাজকে, একজন বাবার মনস্তত্ত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে এবং মায়ের চরিত্রকে যথেষ্ট পজিটিভভাবে প্রেজেন্ট করেছেন। কিন্তু সব মা ই তাঁর লেখায় সৃষ্টি করা মায়ের মত হয় না।

এই বই দিয়ে বানানো মঞ্চ নাটকে একসময় যখন অনাগত সন্তান মাকে বলে,  " ডোন্ট ক্রাই, আই উইল বর্ন এনাদার টাইম"

তখন সে হয়ত নিজের ছোট্ট মস্তিষ্কে অনুধাবন করতে পারে না, যে যায় সে আর ফিরে আসে না। 

মৃত্যু এই আসা যাওয়া,  পৃথিবী ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতাকে রোধ করে দেয়।

হুমায়ুন আজাদ " আমার অবিশ্বাস" বইতে মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন,

"একপাশে শূণ্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,

প'ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থ ঝিনুক।"

 

এই নিরর্থ ঝিনুকের মত করে তুমি পড়ে থাক জড়ায়ুতে।

যে দুজন তোমাকে এনেছিলো নিজেদের খেয়ালে সেই তারাই তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই,  বাতাসে শ্বাস নেবার আগেই হত্যা করতে পারে সুস্থ মাথায় যদি তুমি জন্ম নিয়ে ফেলো দুজন মানুষের বিয়ের আগেই। তুমি নগ্ন পুতুল অথবা তুমি কারো স্বপ্ন পূরণের বস্তু। তোমাকে তারা আনবে, ভাংচুর করে গড়বে, নিজেদের ধর্মের পোশাক তোমার শরীরে পরাবে, নিজেদের প্রথা এবং বিশ্বাসের মানচিত্র ধরিয়ে দিবে তোমার কচি হাতে। 

সবটা মেনে নিলে তারা তোমাকে আহ্লাদিত হয়ে মুকুট পরাবে।   না মানতে পারলে বিদ্রোহী,  অবিশ্বাসী, অসামাজিক সহ আগেভাগেই বানিয়ে রাখা শব্দে তোমাকে জর্জরিত করবে।




লিখেছেন : মোহনা সেতু



🌺জন্মদানবিরোধী🌺 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=( ঠিক আছে ) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটটি / মোবাইল অ্যাপ 18 বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের জন্য নয়
Accept !
To Top