প্রকৃতির দোহাই

এক জন্মদানবিরোধী
0

 


 এক লোকের জীবনের একটি ঘটনা পড়েছিলাম। লোকটি প্রাণী হত্যার সমর্থক ছিলেন না বিধায় নিরামিষভোজী ছিলেন। একবার এক জাহাজযাত্রায় তিনি একটি বড় মাছকে ছোট মাছ জীবন্ত গিলে খেতে দেখে তার বোধোদয় হলো যে, যে মাছ অন্য মাছকে খায়, তাকে খাওয়া অনৈতিক হতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য অন্য প্রাণী হত্যা অনৈতিক নয়, প্রাকৃতিক!

আপনি যদি আমিষভোজী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার এ কথাটি অনেক যৌক্তিক মনে হতে পারে, এ কারণে নয় যে কথাটা আসলেই যৌক্তিক বরং এ কারণে যে আমরা নিজেদের মতের পক্ষে যেটাকে যৌক্তিক মনে করতে চাই, সেটা হাজার অযৌক্তিক হলেও আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়!

.

এবার আসি কথাটি কেন অযৌক্তিক! যা কিছু প্রাকৃতিক তা কিছুই নৈতিক নয়, প্রকৃতিতে কিছু প্রাণী নিজের সন্তানকেও খেয়ে ফেলে, তাই বলে কি সন্তানকে খেয়ে ফেলা নৈতিক হয়ে যাবে? সাগরের একটা মাংসাশী মাছ নিরুপায় হয়েই অন্য মাছকে জীবন্ত খায়, কিন্তু মানুষ মাছ-মাংস না খেয়েও বাঁচতে পারে! অনেকেই মানুষের মাংস খাওয়ার উপযোগী দাঁত দিয়ে প্রমাণ করতে চান মানুষ অতীতকাল থেকেই মাংসাশী ছিলো, তাই মাংস খাওয়া নৈতিক, কিন্তু মানুষ অনাদিকাল থেকে তো একে অন্যকে হত্যাও করে আসছে, তাহলে কি মানুষ হত্যা করাও নৈতিক? শুধু এটাই নয়, মাংস খাওয়ার উপযুক্ত দাঁত থাকলেই যে বাধ্যতামূলক মাংস খেতে হবে এমনটাও কিন্তু নয়, আমাদের নিকটাত্মীয় গরিলার আমাদের মতোই দাঁত থাকার পরেও তারা তৃণভোজী, ভালুকের মতো মাংসাশী প্রাণীর নিকটাত্মীয় হয়েও পান্ডা বাঁশ খেয়ে বাঁচে! তারপরেও ধরে নিলাম আমাদের দাঁত মাংস খাওয়ার উপযোগী,  কিন্তু আমাদের অন্য মানুষকে কামড় দিয়ে আহত করার উপযোগী দাঁত থাকার পরেও কাউকে কামড় দেয়া যেমন নৈতিক হয়ে যায় না, ঠিক তেমনিভাবে মাংস খাওয়ার উপযুক্ত দাঁত আছে বলেই প্রাণী হত্যা করে মাংস খাওয়া নৈতিক হয়ে যায় না! অনেকেই বলেন, মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপাদান মাংস ছাড়া পাওয়া যায় না, তাই মাংস খাওয়া যৌক্তিক! কিন্তু আমাদের যা প্রয়োজন সেটা কেবল আমাদের প্রয়োজন বলে অন্যকে হত্যা করে গ্রহণ করা নৈতিক হয়ে যায় কি? চুরি, চিনতাই, খুন সব মানুষ কোনো না কোনো প্রয়োজনেই করে! মাংস না খেয়ে অনেকেই দিব্যি সুস্থ থাকছে আজীবন, তাই মাংস খাওয়াকে প্রয়োজন না বলে বিলাসিতা বলাই যুক্তিযুক্ত! 

.

এবার আসি নিরামিষভোজীদের নৈতিকতা নিয়ে। কিছু কিছু নিরামিষভোজী দুধ, ডিম, বীজ জাতীয় উদ্ভিজ্জ খাবার খাওয়াকে অনৈতিক মনে করে না, কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখে না এসব প্রাণী ও উদ্ভিদ বংশধর তৈরি ও রক্ষার জন্য উৎপাদন করে, তাদের খাবারের জন্য নয়! তবুও প্রাণীকে যন্ত্রণাদায়কভাবে হত্যা করে খাওয়ার চেয়ে এদের আচরণকে তুলনামূলক নৈতিক বলা যায়! আরেক প্রকার মানুষ আছে যারা বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে মাছ-মাংস খায়, তবে খাওয়ার সময় অনুভব করে যে কাজটা অনৈতিক হচ্ছে! এই শ্রেণীর মানুষ ও নিরামিষভোজী মানুষেরা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ভন্ড হিসেবে প্রমাণিত হয় যখন তারা সন্তান জন্ম দেয়। কেননা একজন মানুষ নিজে মাছ-মাংস খেতে যদি সত্যিই ব্যথিত হয়, তবে সে কোনোভাবেই আরো মানুষ সৃষ্টি করবে না যার বেঁচে থাকার জন্য আরো অনেক প্রাণীকে হত্যা করতে হবে।  অন্যদিকে একজন নিরামিষভোজী নিশ্চয়তা দিতে পারবে না তার ভবিষ্যত বংশধরেরা সবাই নিরামিষভোজী হবে, ফলে একজন নিরামিষভোজীর সন্তান জন্ম দেওয়া তার সারাজীবন নিরামিষভোজী হয়ে বাঁচাটাকে ভবিষ্যতে বৃথাই প্রমাণিত করবে! মানুষের পক্ষে অন্য কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের ক্ষতি না করে বেঁচে থাকা অসম্ভব এটা জানার পরেও মানুষ যেহেতু বেঁচে থাকার প্রায় অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছে নিয়ে জন্ম নেয় ও না চাইতেই অনেকের জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়, তাই মরে যেতে পারে না, নাহলে হয়তো অন্যকে হত্যা করে, অন্যের ক্ষতি করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াকে শ্রেয় ভাবতো। কিন্তু সবকিছু জেনেও নতুন কাউকে জন্ম দেওয়া যাকে অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ হত্যা করে বা তাদের ক্ষতি করে বেঁচে থাকতে হবে, সেটা কোনোভাবেই নৈতিক হতে পারে না!

খাদ্য শৃঙ্খলে এক প্রাণী অন্য প্রাণীকে খেয়ে বেঁচে থাকে কিন্তু মানুষ সে শৃঙ্খলের যন্ত্রণা বুঝতে পারে এবং চাইলে সে অনৈতিক শৃঙ্খল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে, তাহলে কেন সেটা করবে না?

.

কিন্তু নিরামিষভোজী হোক আর ব্যথিত হৃদয়ের আমিষভোজী, সবার জন্যই তো জন্মদান প্রাকৃতিক! আমরা কেবল নিজের অপকর্ম ঢাকতেই প্রকৃতির দোহাই দিই, কিন্তু নিজের স্বার্থে প্রকৃতির ধার ধারি না। যৌনমিলনের ফলে সন্তান জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাটা প্রাকৃতিক কিন্তু সেটা আমরা কনডম বা ইমার্জেন্সি পিল সহ নানাভাবে ঠেকিয়ে রাখতে চাই। অর্থাৎ আমরা অধিকাংশ সময় যৌনতার সুখ নিতে চাই শিশু জন্ম নেয়ার ঝামেলার আশঙ্কা ছাড়াই! মানুষ প্রকৃতির দাসত্ব এড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে, অর্থাৎ চাইলেই তারা  নতুন কাউকে যন্ত্রণার অস্তিত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, এটা দোষের কিছু মোটেই নয়। কিন্তু ভন্ডামীটা হলো নিজের স্বার্থে খেয়ালখুশি অনুযায়ী কাউকে জন্ম দিয়ে সেটাকে প্রাকৃতিক বলা! একজন শিশুকে জন্ম দেয়ার সময় আমরা কেবল নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথাই ভাবী, তাই শিশু জন্মদানের সময় শিশুকে অবজেক্ট হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, যেটা কোনোভাবেই নৈতিক হতে পারে না।





লিখেছেন : 🌹Shams Arko🌹 

শামস অর্কের ব্লগ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=( ঠিক আছে ) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটটি / মোবাইল অ্যাপ 18 বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের জন্য নয়
Accept !
To Top