অনুমতি

এক জন্মদানবিরোধী
0


.


আপনি কি আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, সুখী? যদি আপনি আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার কি উচিত আরেকজনকে 'জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে' জন্ম দেয়া? আর আপনি যদি জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ও সুখী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার সন্তান নেওয়ার কি প্রয়োজন? আর জন্ম দিলেও আপনি কি পারবেন 'আপনার সন্তান তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হবে' এমন নিশ্চয়তা দিতে? আপনি কি শারীরিক এবং মানসিকভাবে শতভাগ উপযুক্ত? যদি না হয়ে থাকেন (খুব সম্ভবত কেউই শতভাগ উপযুক্ত নয়) তাহলে কেন সন্তান জন্ম দিয়ে আপনার মধ্যকার ত্রুটি তার অনিচ্ছায় তার উপর চাপিয়ে দিয়ে সেজন্য তাকে ভোগানোর মতো অনৈতিক কাজ করতে চান? ধরে নিলাম, জন্ম দেওয়ার সময় আপনার কোনো প্রকার ত্রুটি ছিলো না, কিন্তু সেটা কখনোই আজীবন কোনো ত্রুটি তৈরি হবে না এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর আপনার মানসিক অশান্তির জন্য সন্তানের সাথে বাজে আচরণের ফলে মানসিক যন্ত্রণা চাপানো কিংবা শারীরিক অসুস্থতার বোঝা চাপানোকে কি আপনি নৈতিক মনে করেন?

.

কোনো কাজ নৈতিক বা অনৈতিক বলার একটি বড় ভিত্তি হলো ঐ কাজের প্রভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার অনুমতি। কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে যে সন্তানকে জীবনযন্ত্রণা ভুগতে হবে তার অনুমতি নেওয়া সম্ভব নয়! অবশ্য অনুমতি নেওয়া সম্ভব নয় এমন অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কাজও নৈতিক বলে বিবেচিত হতে পারে, যেমন: কেউ আনমনে হাঁটতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে (তাকে কোনোভাবে সতর্ক করার সুযোগ না থাকলে) তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া। ধাক্কার ফলে সে পড়ে গিয়ে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তার তুলনামূলক লাভ বিবেচনায় সে আঘাতপ্রাপ্তিকে হয়তো নৈতিক বলা যেতে পারে। অনেকে এই ব্যাপারটাকে সন্তান জন্মদানের সাথে মিলিয়ে সন্তান জন্মদানকে নৈতিক প্রমাণের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এ চেষ্টার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এখানে আপনি জন্ম দেওয়ার আগে আপনার সন্তানের অস্তিত্বই থাকে না, যার অস্তিত্বই নেই তাকে বৃহৎ অকল্যাণের (অনস্তিত্ব মোটেই খারাপ কিছু নয়) হাত থেকে বাঁচাতে জীবনযন্ত্রণা দেয়াটা পরিহাস হয়ে যায়।

.

আরেকটু সহজভাবে বলি, ধরুন আপনার সন্তান পানিতে পড়েনি। আরেকজনের সন্তান পানিতে পড়ে ডুবে মরে গেছে। এখন আপনি কি আপনার সন্তানকে পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচাতে পানিতে ফেলে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন নাকি আপনি তাকে পানিতেই পড়তে দিবেন না? আপনার যদি কারো সন্তান পানিতে পড়ে মরে যাওয়া দেখে খারাপ লাগে তাহলে আপনার উচিত হবে কারো সন্তান পানিতে পড়ে গেলে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা, আপনার সন্তানকেও পানিতে ফেলা নয়! তেমনি পৃথিবীতে লক্ষ কোটি শিশু ও মানুষ অনাহারে, নির্যাতনে, চরম মানসিক যন্ত্রণায়, অবহেলায় বেঁচে আছে, আপনি তাদের দেখে মর্মাহত হলে তাদের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করুন, তাদের দুঃখে মর্মাহত হয়ে আপনি নিজে সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে যন্ত্রণার জীবন দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা রাস্তার অপরিষ্কার অংশ দেখে মর্মাহত হয়ে পরিষ্কার অংশে নতুন করে ময়লা ফেলে ঝাড়ু দেয়ার মতোই অযৌক্তিক কাজ কেননা আপনার সন্তানকে জন্ম দিয়ে আপনি পৃথিবীর মানুষের কষ্ট লাঘব তো করছেনই না বরং আরো একজন মানুষকে যন্ত্রণার জীবন দিয়ে জীবনযন্ত্রণা ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। যদি পৃথিবীর জন্য কিছু করতেই চান তাহলে অন্তত নতুন করে কাউকে জীবনযন্ত্রণার অস্তিত্ব না দিয়ে একজন অস্তিত্বশীল মানুষের জীবনযন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করুন।

.

অনেকে এই যুক্তিতে সন্তান জন্মদানের পক্ষে বলেন যে, আমি আমার সন্তানকে এত ভালো রাখবো যে সে তাকে জন্ম দেওয়ার আমাদের সিদ্ধান্তটি নিয়ে খুশিই থাকবে। কিন্তু আগেই বলেছি বাবা-মায়ের হাজার চেষ্টাও সন্তানের জীবন সুখের হবে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমরা চোখ বন্ধ করে সত্যকে অস্বীকার করে সবকিছু নিজেদের ভাবনার সমর্থনেই ভাবতে চাই! আমরা ভাবি কত ছেলে মেয়ে বাবা-মাকে তাকে জন্ম দেয়ার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে, কত ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, সেবা করে কিন্তু আমরা এই সত্য স্বীকার করতে চাই না যে সকল সন্তান তাদের অনিচ্ছাতেই সমাজ ও পরিবারের শিক্ষা ও তার প্রতি অযাচিত যত্ন ও সেসবের ফিরিস্তি শুনে বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার শেকলে বন্দী হয়ে থাকে। একটি খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি যদি বলে, 'সে তাকে এত যত্ন করায়, খাবার দেয়ায় তাকে খাঁচায় বন্দি করা মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞ' তাহলে সেটা কি প্রকৃত সত্য বলে মেনে নিবেন? আপনার সত্যানুরাগ ও চিন্তাশীলতা না থাকলে হয়তো মেনে নিবেন, কিন্তু সত্যানুরাগী চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই মানবেন মানুষ পাখির মতোই স্বাধীন থাকতে চায় তবুও সে  তোতাপাখির মতোই পরিবার ও সমাজের শেখানো কৃতজ্ঞতা, মায়ার বুলি বলে যেতে বাধ্য হয়! কত ছেলে মেয়ে শুধু বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে, তারা কষ্ট পাবে ভেবে চুপ করে তাদের সব অযৌক্তিক কথা মেনে নেয়, তাদের উপর চাপানো যন্ত্রণা সয়ে হাসিমুখের অভিনয় করে যায় (উদাহরণ হতে পারে বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেয়া খারাপ পরিবারে বিয়ে হওয়া মেয়েগুলো), মুখ ফুটে প্রতিবাদটুকুও করতে পারে না, সেটা উপলব্ধি না করলে আপনার কখনোই মাথায় ঢুকবে না সমাজে এত অবিচার-অনাচার সত্ত্বেও কেন মানুষ চুপ করে থাকে? তাই একটু গভীরে ভাবুন, স্বৈরাচারী শাসক অপছন্দ অবশ্যই করুন, তার আগে নিজে যেসব স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত চাপাচ্ছেন আপনার সন্তান ও অন্যদের উপর, সেসব উপলব্ধি করুন! 


লিখেছেন : 🌹Shams Arko🌹 

শামস অর্কের ব্লগ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=( ঠিক আছে ) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটটি / মোবাইল অ্যাপ 18 বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের জন্য নয়
Accept !
To Top