জন্মদানবিরোধ ১১

এক জন্মদানবিরোধী
0

স্বাধীনতা, আত্মহত্যা, ধর্ম ও জন্মদানবিরোধ


.

মানুষ কি স্বাধীন? এ প্রশ্ন অনাদিকাল থেকে বিতর্কের বিষয়, যদিও মূল বিতর্ক ঈশ্বরের অধীন কিনা তা নিয়ে। কিন্তু আমরা ধরে নিই ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তাহলে কি মানুষ স্বাধীন? কিছু কিছু মানুষ বলে আমি স্বাধীন, কিন্তু আসলেই কি একটা মানুষ কোনোভাবে স্বাধীন হতে পারে? একটা মানুষ জন্ম নেয় অন্যের ইচ্ছায়, যার জন্মই তার অধীনে নেই সে নিজেকে স্বাধীন বলা তার অজ্ঞতা কিংবা ভন্ডামী! মানুষের (আত্মহত্যা ছাড়া) মৃত্যু কি তার অধীন? আত্মহত্যাটাও কি মানুষের অধীন? মানুষের জৈবিক সংগঠন তাকে সব কষ্ট সয়েও বাঁচিয়ে রাখতে চায় আবার সমাজ ও আশেপাশের মানুষগুলো ও পরিস্থিতি আত্মহত্যায় বাধ্য করে, তাহলে আত্মহত্যাটাই নিজের অধীন কোথায়? জন্ম-মৃত্যু আপনার অধীন নয়, বাকী জীবনটা কি তাহলে আপনার অধীন? আপনি কি জানেন কেবলমাত্র আপনার জন্মটাই আপনার জীবনের বড় একটা অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে? কেমন পরিবারে-সমাজে-দেশে-ধর্মে জন্মেছেন, বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা, প্রতিবেশী - আত্মীয়রা কেমন, আপনার নিজের চেহারা-দৈহিক সামগ্রিক গড়ন-মস্তিষ্কের ক্ষমতা-জেনেটিক বৈশিষ্ট্য কেমন এসবকিছুই আপনার জীবনকে প্রচন্ডভাবে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে পারে। আপনি হয়তো সবকিছু ছেড়ে নিজে আত্মকেন্দ্রিক সন্ন্যাস নিয়ে সুখ পাওয়ার কথা ভাবতে পারেন কিন্তু আপনাকে মানতে হবে সেটা আপনি প্রকৃতি ও প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করেই করছেন! তাহলে কেন সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো অনৈতিক কাজটি থেকে প্রকৃতিকে অস্বীকার করে বিরত থাকতে পারবেন না? নিজে পরাধীন বুঝতে পারার পরেও আরেকজনকে পরাধীনতার জীবন দিয়ে যন্ত্রণা দেয়া নৈতিক হয় কিভাবে? 

.

এবার ধরুন আপনি পৃথিবীর মোটামুটি একটা ভালো পরিবারে জন্মেছেন, তাহলেই কি আপনি স্বাধীন?  আপনি কি চাইলেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকতে পারবেন? কিংবা না খেয়ে? কিংবা একেবারেই না ঘুমিয়ে? কেন খাওয়া ও নিঃশ্বাসের প্রসঙ্গ আনলাম? আমরা অধিকাংশ মানুষ আমাদের জীবনের বড় সময় বাধ্য হয়েই ব্যয় করি বেঁচে থাকার জন্য খাবার কেনার টাকা উপার্জনে ও ঘুমে! (যদিও পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষের জীবন আরো অনেক বেশি জটিল হয়েছে!) আর নিঃশ্বাসের প্রসঙ্গ কেন আনলাম? এটা তারা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝবেন যারা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্টে ভুগে প্রতিটি নিঃশ্বাসের জন্য কলজে-ছেঁড়া যন্ত্রণা সয়ে সংগ্রাম করতে হয়। এ লোকগুলোর জন্য কি সমাধান দিবেন? যন্ত্রণার কারণ অর্থাৎ শ্বাস নেয়া বন্ধ করা? প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত যৌন আকর্ষণের ফলে সৃষ্ট প্রেম কেন্দ্রিক জটিলতাসহ অন্যান্য জটিলতার কথা নাইবা আনলাম! এতকিছুর পরেও নিজেকে স্বাধীন মনে করা লোকগুলোকে ভন্ড না বললেও অন্তত সৎ/জ্ঞানী বলা যায় না!

.

জীবনের এই জটিলতার, পরাধীনতার সমাধান কি তাহলে আত্মহত্যা? কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাধীনতার অভাব, যন্ত্রণা এসব হচ্ছে আত্মহত্যার কারণ, তাই জীবনের এসব যন্ত্রণার ধারণা ছুঁড়ে ফেলে নতুন করে স্বাধীন জীবন শুরু করাটাই সমাধান।  কিন্তু তারা এই সত্যটি অস্বীকার করছে যে এত জটিলতা, এত যন্ত্রণার মূল কারণ জীবন, জীবন থাকলে যন্ত্রণা,জটিলতা থাকবে, আপনি শুধুমাত্র নিজের সাথে মিথ্যা বলে, আত্মপ্রতারণার মাধ্যমে সেসব অস্বীকার করতে পারেন! এখানে আরো একটি সমস্যা হচ্ছে,  একজন মানুষ তার জীবনকে নতুন করে শুরু করে সমাধান পেয়েছে বলে অন্যরাও পাবে এমন নয়, একজন নিজের জীবন নতুন করে শুরু করতে পেরেছে বলেই অন্যরাও পারবে এমনটাও নয়, কেননা সবার পরিস্থিতি, সক্ষমতা এক থাকে না! তাহলে আমি যে বলেছি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সমাধান, সেটা কিভাবে? আপনি নিজে জীবন যন্ত্রণা অনেক চেষ্টায় এড়িয়ে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা পেলেন, কিন্তু আপনি সন্তান জন্ম দিলে সে সন্তান যে জটিলতায় পড়ে আত্মহত্যা করবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়?

.

পৃথিবীতে কিছু সহজ সত্য অস্বীকার করি বলেই যুগে যুগে আমরা জটিলতা সৃষ্টি করেছি। মৃত্যুর পরে আমাদের চেতনার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না এই সহজ সত্য মানতে পারিনি বলেই যুগে যুগে অন্ধবিশ্বাস - গোঁড়া ধর্ম গড়ে উঠেছে। তেমনি মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে কিছুই আসবে যাবে না এত সহজ সত্য আমরা স্বীকার করি না। হারারি স্যারের মতো একজন জ্ঞানী মানুষও জীবনের অর্থ নেই স্বীকার করলেও জন্মদানের বিরোধিতা করেননি কেননা মানুষের কাছে ধর্মের চেয়েও জন্মদানের প্রবৃত্তির দাসত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেটা অস্বীকার করে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব নয় বললেই চলে! আগের যুগে অনেক জমিদার তার সম্পত্তি মৃত্যুর পরে কে ভোগ করবে সেটা ভেবে সন্তান জন্ম দেয়াকে গুরুত্ব দিতো, কিন্তু সে জমিদারের মৃত্যুর পর তার সন্তানরা যে বছর কয়েকের মধ্যে খামখেয়ালি করে সব সম্পত্তি হারিয়ে পথে বসবে না এমন নিশ্চয়তা ছিলো কি?

.

পুঁজিবাদ বলেন, সমাজতন্ত্র বলেন, ধর্ম বলেন এরা মানুষ চায়, কেননা মানুষ ছাড়া কোনো তন্ত্র বা ধর্মই টিকে থাকবে না, সেজন্য ধর্ম ও বিভিন্ন তন্ত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সন্তান জন্ম দিলে ইহকালীন ও পরকালীন নানা সুবিধাপ্রাপ্তির বর্ণনা রয়েছে। পুঁজিপতিরা মানুষ চায় দাস হিসেবে, বর্তমান চাকরি ব্যবস্থায় যত লোভনীয় বেতন আর সুবিধাই থাক, একজন চাকরিজীবী পুঁজিপতিদের দাস ছাড়া কিছুই নয় যারা পরোক্ষভাবে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে যাচ্ছে ! তাই পুঁজিবাদ অপছন্দ করা একটা মানুষ পুঁজিবাদী সমাজে একটি শিশুর জন্ম দেয়া আসলে পুঁজিবাদের দাসের জন্ম দেয়া। অনেকে ভাববেন সমাজতন্ত্র তো ভালো ব্যাপার কিন্তু বাস্তবতা হলো সমাজতন্ত্র কখনোই মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবেনি, শ্রেণীশত্রু খতমের জটিলতায় নাইবা গেলাম, সমাজতন্ত্র মানুষকে উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই বিবেচনা করে আর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা হরণ ছাড়া কোথাও সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বাচ্চা জন্ম না দিলে আলাদা কর দিতে বাধ্য করার ইতিহাসও ভাবার মতোই!

.

অনেকে হয়তো ভাববেন যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না জন্মদানবিরোধ তো কেবল তাদের জন্যই। কিন্তু আসলেই কি তা? ধর্ম সন্তান জন্মদানে উৎসাহ দিলেও কেউ সন্তান জন্ম না দিলে জাহান্নামে/নরকে যাবে এমনটা কোথাও বলেছে? বরং আপনি ধর্মবিশ্বাসী হলেও আপনার সন্তান জন্ম না দেয়াই উচিত।  আপনি নিশ্চয়ই জানেন মানুষ মাত্রই পাপ করে আর ছোটোখাটো পাপেও জাহান্নামে  কতো কঠোর শাস্তি পাওয়ার কথা বলা আছে, এজন্য দেখবেন সন্তান নামাজ না পড়লে বাবা মা সন্তান জাহান্নামে যাবে ভেবে আবেগী হয়ে পড়ে! শুধু কি তাই?  সন্তান পাপী হলে তার জন্য  বাবা মাকেও জবাবদিহি করতে হবে এই ভয়ে অনেক বাবা-মা সন্তানকে ধর্ম পালনে জোরও করেন, সেটা কি নৈতিক কাজ হয়? অনেক পরিবারেই শত চেষ্টার ফলেও সন্তান ধর্ম মানে না, তখন সন্তানকে জাহান্নামে জ্বলতেই হবে। কিন্তু সন্তান জন্ম না দিলে অন্তত সন্তান জাহান্নামে জ্বলবে ভয় তো থাকবেই না উপরন্তু সন্তানকে ধর্মের পথে রাখতে না পারার জন্য জবাবদিহিও করতে হবে না। তাই ধর্মবিশ্বাসীরা নিজের বিশ্বাস থেকে নিজের ও সন্তানের ভালো যদি আসলেই চায় তাহলে তাদেরও উচিত হবে সন্তান জন্ম না দেয়া!

কেননা সন্তান জন্ম দেয়ার পর আপনার শত চেষ্টার পরেও সন্তান ভালো না হলে, 'এর চেয়ে যদি আমার সন্তানই না থাকতো!' বলে আফসোস করা ছাড়া কিছুই  করার থাকবে না!


লিখেছেন : 🌹Shams Arko🌹 

শামস অর্কের ব্লগ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=( ঠিক আছে ) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটটি / মোবাইল অ্যাপ 18 বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের জন্য নয়
Accept !
To Top