জীবনের একটি অংশ সত্যিই কষ্টের যেমন ক্যান্সার, পঙ্গুত্ব ও দুর্যোগ। যদিও জীবন সূর্যাস্ত, চকলেট আইসক্রিম আর অর্গাজমের মতো সুন্দর অভিজ্ঞতাও উপহার দেয়। অনেকেই যুক্তি দেয় যে এই ভালো ব্যাপারগুলো খারাপ ব্যাপারগুলোকে ন্যায্যতা প্রদান করে। চলুন আমরা এ যুক্তিটি আরও গভীরভাবে যাচাই করে দেখি।
যখন থেকে আপনি সংবেদনশীল তখন থেকে আপনাকে অবশ্যই ভালো অনুভূতিগুলো পেতে হবে যাতে আপনি খারাপ অনুভূতিগুলো এড়াতে পারেন। অস্তিত্বে আসার আগে ভালো বা খারাপের অনুভূতি ছিলো না কেননা তখন সংবেদনশীলতাই ছিলো না। তাই যতক্ষণ আমরা কাউকে অস্তিত্বে না আনি ততক্ষণ ভালোর অনুপস্থিতি কোনো সমস্যাই নয়।
মৌলিক প্রয়োজন বিবেচনায় নিলে:
আপনি না খেলে ক্ষুধার্ত হবেন।
আপনি পান না করলে তৃষ্ণার্ত হবেন।
আপনি যদি মলত্যাগ না করেন, আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হবে।
আপনি যদি অর্গাজম না করেন, আপনি উত্তেজনা অনুভব করবেন।
এভাবে ভালো কিছু পাওয়ার মাধ্যমে আপনি অধিকতর খারাপ কিছু থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছেন। কিন্তু আপনার জন্মই না হলে যতটা কার্যকরভাবে সব খারাপ থেকে বাঁচতে পারতেন সেটা অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আমরা কোনো জীবকে সংবেদনশীল করার মাধ্যমে তার উপকার করি এই ধারণাটি ত্রুটিপূর্ণ। অস্তিত্বশীল হওয়ার পূর্বে তার খারাপ অনুভূতি এড়ানোর জন্য ভালো অনুভূতি লাভের আবশ্যকতা ছিলো না কেননা তখন তার অস্তিত্বই ছিলো না। একবার সে অস্তিত্বশীল হলে তার খারাপ অনুভূতি এড়ানোর জন্য ভালো অনুভূতি পাওয়া লাগবেই। এটা অনেকটা রোগের উপশমের জন্য নতুন করে রোগ তৈরির মতোই।
তাই আপনি যখন একটি শিশুকে তার ভালো হবে ভেবে অস্তিত্বে আনেন, আপনি আসলে সমস্যা সমাধানের জন্য একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছেন। এটা তেমনই অযৌক্তিক যেমন অযৌক্তিক আগুন নেভানোর জন্য একটি ঘরে আগুন দেয়া, কাউকে এইডস রোগের চিকিৎসা দেয়ার জন্য তার শরীরে এইডসের ভাইরাস দেয়া কিংবা কাউকে ব্যান্ডেজ ও পেইনকিলার দেয়ার জন্য তার পা ভেঙে দেয়া বা বুকে চুরিকাঘাত করা। আপনি এখানে যন্ত্রণা দূর করার জন্য প্রথমে যন্ত্রণা তৈরি করছেন।
আমি যদি আপনার ঘরে আগুন না লাগাই তাহলে তো আপনার সেটা নেভানোর প্রয়োজনই হবে না। তাই এমনটা যুক্তি দেয়া একদমই উদ্ভট যে আপনি খারাপ কিছু (ঘরে আগুন) সৃষ্টি করে তা দূর করার মাধ্যমে ভালো কিছু অর্জন করছেন কেননা সেই ভালোটা আপনার দুর্ভোগের সাপেক্ষে আসে।
আপনার খাওয়ার ইচ্ছা যদি একেবারে চলে যায় তাহলে খাবার আপনাকে আর আনন্দ দিবে না। খাওয়ার ইচ্ছাকে আপনি রুচি বলুন আর ক্ষুধা, ক্ষুধা কষ্টের কিন্তু ক্ষুধার পরিবর্তে যদি রুচিও হয় সেটাও যন্ত্রণার। আপনাকে যদি আপনার পছন্দের খাবার কখনওই খেতে দেয়া না হয় তাহলে সেটা আপনার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করবে, যে অস্বস্তি অতোটা তীব্র নয় কিংবা দৈনন্দিন জীবনে দৃষ্টিগ্রাহ্যও নয়।
যদি অপূর্ণ চাহিদা ইতোমধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে সেটা পূরণ করা ভালো বলে বিবেচিত হবে। তবে অপূর্ণ চাহিদা নতুন করে তৈরি করা ভালো বলে বিবেচিত হবে না। তেমনটা করলে আপনি একটি শিশুকে অভাব ও খারাপ অবস্থায় পতিত করছেন। এটা একটি ঘরকে পুড়তে দেখা বা একটি শিশুকে সাগরে ডুবতে দেখারর মতো। যদিও আগুন নেভানো বা শিশুটিকে বাঁচানো ভালো কাজ তবে এর জন্য প্রথমে ঘরে আগুন দেয়া বা শিশুটিকে সাগরে নিক্ষেপ করা ভালো কাজ নয়। আপনি তাহলে কেবলমাত্র সমস্যা নতুন করে তৈরি করছেন!
সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, সমস্যার উপশম হবেই এমনটা সুনিশ্চিত নয়। যারা জন্ম দেয় তারা কখনোই নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে জন্ম দেওয়া শিশুটির জীবনের সকল চাহিদা পূরণ হবে। চাহিদা বা অভাব কতটা যন্ত্রণা দিবে, চাহিদা পূরণের আনন্দ কতটা স্থায়ী হবে কিংবা অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া আদৌ এসব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব কি না এসবের নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা একটি চাহিদার যন্ত্র (শিশু) তৈরি করে।
অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায় আবার অনেক চাহিদাই অন্যের ক্ষতির বিনিময়ে পূরণ হয়।
সারাহ তার গর্ভাবস্থার প্রথমদিকেই জানতে পারে যে তার ভ্রুণটির একটি রোগে আক্রান্ত যা প্রতিবন্ধিত্ব ও যন্ত্রণা বয়ে আনবে। কেউ কেউ যুক্তি দেখাবে যে সারাহ'র গর্ভাবস্থাকে সন্তান জন্ম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে কেননা তারা বিশ্বাস করে গর্ভপাত সবসময়ই খারাপ! যদিও অন্যরা বিশ্বাস করে যে সারাহ'র গর্ভপাত করা উচিত কিংবা সে চাইলে গর্ভপাত করতে পারে।
ধরে নিচ্ছি যে, সারাহ'র নিজের জৈবিক সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকার রয়েছে।
যারা বিশ্বাস করে গর্ভপাত সবসময় ভুল তারা সন্তানের কল্যাণ এবং জন্ম দেওয়ার মধ্যে কোন বিরোধ দেখে না।
জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা যুক্তি দেয় যে, তাকে অবশ্যই এই অধিকারটি দিতে হবে।
যাইহোক, যারা বিশ্বাস করে যে গর্ভপাত নৈতিকভাবে অনুমোদিত নয়, তাদের অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন সারাহ'র সন্তান জন্মদানের অধিকার তার সন্তানের প্রত্যাশিত যন্ত্রণার চেয়ে বেশি।
এই পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে, অধিকার এবং বাধ্যবাধকতার মধ্যে বিরোধ রয়েছে।
জবাবে অনেকে (জন্মদানবিরোধীরা সহ) মনে করে কারো জন্ম দেওয়ার অধিকার সীমিত করতে হবে যদি এর পরিণতি যথেষ্ট ক্ষতিকারক হয়।
'
আমরা জন্মদানবিরোধীরা বিশেষ করে, জন্ম দেওয়ার অধিকার সীমিত করতে বলি তখন আমাদের যুক্তি হলো
অস্তিত্ব নিজেই একটি ক্ষতি যা জন্ম দেওয়ার অধিকারকে ছাড়িয়ে যায়।
এজন্য আমরা বিশ্বাস করি একটি শিশুর কষ্ট কমানোর বাধ্যবাধকতা এবং মা-বাবার সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকারের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব রয়েছে।
তাই জন্ম দেওয়ার অধিকার ত্রুটিপূর্ণ হওয়াই জন্ম না দেওয়াই উত্তম।
বিকল্প উত্তর-
প্রজননের কাজকে প্রায়শই একটি প্রাকৃতিক এবং প্রশ্নাতীত অধিকার হিসাবে দেখা হয়। যেটির নৈতিকতা আরো গভীরভাবে যাচাই করা উচিৎ।
ঐতিহ্যগতভাবে, এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে প্রত্যেকেরই সহজাতভাবে সন্তান লাভ এবং পরিবার গঠনের অধিকার রয়েছে। যদিও এমনটা ধরে নেওয়া হচ্ছে কাউকে অস্তিত্বে আনার নৈতিক প্রভাবকে উপেক্ষা করে।
জন্ম দেওয়া নির্দোষ একটি কাজ এই বিশ্বাসের বিপরীতে যথেষ্ট নৈতিক উদ্বেগ রয়েছে।
দার্শনিক আলোচনা ঐতিহাসিকভাবে প্রজননের নির্দিষ্ট দিকগুলি যেমন: গর্ভপাত এবং জীনগত প্রভাব ইত্যাদির উপর দৃষ্টিপাত করেছে। যেখানে জন্ম দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন নৈতিক অধিকার আছে কি-না এই কিনা মৌলিক প্রশ্নটি অবহেলা করা হয়েছে। তবুও বিশ্বে একটি নতুন কাউকে নিয়ে আসার ন্যায্যতা যাচাই প্রয়োজন, কারণ এর মাধ্যমে একটি দুর্বল সত্তার সৃষ্টি হয় যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আমরা জন্মদানবিরোধীরা 'জন্ম দেওয়া নৈতিক' এই অনুমানটিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে চাই।
এক্ষেত্রে আমাদের যুক্তি হচ্ছে, জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে করো উপর তার অনুমতি ছাড়াই উল্লেখযোগ্য এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতি আরোপ করা হয়। অধিকন্তু, অস্তিত্বের যে সুবিধাগুলি ধরে নেওয়া হয় সেটা প্রায়শই মানুষ জীবনে যে দুর্ভোগ এবং যন্ত্রণা পায় ছাড়িয়ে যেতে ব্যর্থ হয়।
জন্ম দেওয়ার অধিকার এবং যাকে অস্তিত্বে আনা হবে তার অধিকার দুটোকে আলাদাভাবে ভাবার অবকাশ নেই।
জন্মদানের সমর্থকদের অবশ্যই দেখাতে হবে যে এই অধিকারগুলো নতুন যাকে জন্ম দেওয়া হবে তার উপর আরোপিত সম্ভাব্য ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যাবে।
যাই হোক, জন্ম দেওয়ার পেছনে শিশুর মঙ্গলের চিন্তার চেয়ে আত্ম-স্বার্থই বেশি কাজ করে।
এ-র ফলে শিশুটিকে বংশধারা বজায় রাখা, সম্পত্তি হস্থানান্তর কিংবা পিতামাতার আকাঙ্ক্ষা পূরণের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয় ; যা জন্ম দেওয়ার নৈতিক দিককে অবমূল্যায়ন করে।
যদিও মানুষের সন্তান জন্মদানের জন্য নিজস্ব কোনো কারণ থাকতে পারে তবে তাদের অবশ্যই
সন্তানের অন্তর্নিহিত মূল্য এবং স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সন্তানকে যদি আসলেই গুরুত্ব দিতে হয় এবং মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করতে হয় তাহলে তার স্বার্থ এবং স্বাধীনতাকে সম্মান দিতে হবে।
সম্ভাব্য পিতা-মাতাদের উপর তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য সন্তানের সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং প্রভাব বিবেচনা করার দায় বর্তায়।
জন্মদানবিরোধীদের দৃষ্টিতে যদি কারো জন্ম দেওয়ার অধিকার থাকেও তবে তা অবশ্যই হওয়া উচিত অন্যদের স্বার্থের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ যাদের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
যে শিশুকে তার অনুমতি ছাড়া জন্ম দেওয়া হবে এবং তৃতীয় পক্ষ যারা জন্মদানকে ক্ষতি হিসেবে দেখে অথবা জন্ম দেওয়ার পরিবর্তে দত্তক নেওয়ার পক্ষে)।
অস্তিত্বে আসার কোন সহজাত সুবিধা নেই। একবার অস্তিত্বে আনলে কিছু আনন্দ এবং ভালো লাগার অনুভূতি তো হবেই। কিন্তু কাউকে কখনো অস্তিত্বে না আনলে এগুলো থেকে বঞ্চিত হবে না। কারণ তার অস্তিত্বই নেই। বিপরীতে, আনন্দের অনুপস্থিতি একজন অস্তিত্বশীল ব্যক্তির জন্য এক ধরনের ক্ষতি। যখন অস্তিত্বহীনতার জন্য আনন্দ অনুপস্থিত তখন সেখানে কোনো খারাপ অনুভূতিও থাকে না। তবুও, কাউকে অস্তিত্বে আনলে সে নিশ্চিতভাবেই কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হবে ব্যক্তিভেদে তার ধরন এবং তীব্রতার ভিন্নতা থাকতে পারে। আমাদের বক্তব্য হলো, সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের জীবনেও অনেক যন্ত্রণা রয়েছে। ফলস্বরূপ, যুক্তিটি এমন দাঁড়ায় যে, নতুন কাউকে অস্তিত্বে আনলে তার পাওয়ার কিছু নেই কিন্তু হারানোর অনেক কিছুই রয়েছে।
এজন্য আমাদের নতুন কোনো শিশুকে এই যন্ত্রণার পৃথিবীতে আনা থেকে বিরত থাকা উচিত।
এই যুক্তি অনুসারে, আপনাকে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও এটা মেনে নিতে হবে যে, ভবিষ্যৎ নৃশংসতার পরিকল্পনা করা দোষের কিছু নয় কেননা বর্তমানে তার অস্তিত্ব নেই। তাই ভবিষ্যতে কী হবে তাতে কিছু যাই আসেনা।
এমন-কি একটি শিশুর জন্ম হতে বাধা দেওয়ার কোনো মানে হয় না যদিও সে ভবিষ্যতে প্রতিদিন নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করবে এবং গুরুতরভাবে পঙ্গু হবে। কেননা এখনো তার অস্তিত্ব নেই। তাই যন্ত্রণা প্রতিরোধ করলেও শিশুটির কিছু যায় আসে না। যেহেতু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এখনও কোনো অস্তিত্ব নেই তাহলে তাদের জন্য আমি যতখুশি পরিবেশ দূষিত করলে সমস্যা কোথায়?
বস্তুত, কেন কেউ আত্মহত্যা করবে যদি সে এটা মনে না করে যে সে মরে গেলে তার যন্ত্রণা প্রতিরোধ করা যাবে। প্রতিরোধ করা মূল্যহীন, তাইতো?
এটাকে নন আইডেন্টিটি প্রবলেম বলা হয়। ভবিষ্যৎ ক্ষতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা এখন যা করছি তার প্রভাব ভবিষ্যতে থাকবে। তাই প্রজননের ক্ষেত্রকে এর ব্যতিক্রম ভাবাটা ভণ্ডামি। আসলে প্রজননের ক্ষেত্রে আমরা জানি না ভবিষ্যৎ শিকার কি দুর্ভোগের লটারি জিতবে এবং তারা যে ভবিষ্যতে মারাত্মক প্রতিবন্ধী হবে না ও প্রতিদিন নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করবে না সেটাও শুরু থেকে স্পষ্ট নয়।
এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন মানবজাতি বিলুপ্ত হবে। যদিও মানবজাতি ও অন্য সংবেদনশীল প্রাণীর বিলুপ্তি জন্মদানবিরোধের নিহিতার্থ, তথাপি জন্মদানবিরোধীরা মনে করে না যে মানুষ জন্মদানবিরোধী হওয়ার মাধ্যমেই তাদের বিলুপ্তি ঘটবে।
সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মহাজাগতিক ঘটনা যেমন উল্কাপিণ্ড/গ্রহাণুর আঘাত, পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হওয়া কিংবা মহামারীর প্রাদুর্ভাব। কারণ যাই হোক না কেন কওনোনা কোনো প্রজন্ম তো শেষ প্রজন্ম হবে। তাই আসল প্রশ্ন দাঁড়ায় বিলুপ্তি তাড়াতাড়ি হবে নাকি বিলম্বিত হবে।
আমাদের (জন্মদানবিরোধীদের) মতে মানবজাতি বিলুপ্তির ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের উপায় আছে। আমরা মানুষ হত্যা বা মানুষের নির্মম মৃত্যুর মাধ্যমে বিলুপ্তি চাই না কেননা এটা প্রত্যেকের জন্যই দুর্ভোগের হবে।
এর পরিবর্তে আমরা এমন বিলুপ্তি চাই যার জন্য কোনো মূল্য চুকাতে হবে না আর তা হচ্ছে নতুন কাউকে অস্তিত্বে না আনার মাধ্যমে। এভাবে আমরা কাউকে জীবনের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পারি।
নিশ্চিতভাবেই বিলুপ্তির জন্য গণহত্যা, জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্বকরণ সহ আরও অনেক উপায় আছে যেগুলো অগ্রহণযোগ্য। স্বেচ্ছায় প্রজনন বন্ধ করে দেয়া এগুলোর মতো নয়। এটি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল সমস্যার একটি অহিংস সমাধান।
জন্মদান বেআইনি নয়, এটা বেআইনি ঘোষিত হোক এটাও আমরা চাই না যদিও আমাদের নৈতিক অবস্থান ভিন্ন। আমরা মনে করি এটা নৈতিকভাবে অন্যায়, কিন্তু নৈতিক অবস্থান ও যারা জন্ম দেয় তাদের বিচার করা এক ব্যাপার নয়। আমাদের সবারই ভুল হয়, যেহেতু আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই। নৈতিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে সবাই ভাবে না বা ভাবার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাই কেউ জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেই তাকে খারাপ ভাবার পক্ষে আমরা নই। বরং এই ব্যাপারটিকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে তবেই আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন যে জন্মদান থেকে বিরত থাকা আমাদের উচিত কি-না!
কোনো কাজ ভুল কি-না আর কোনো কাজের জন্য কেউ কতটা দোষী এই দুটি ব্যাপার এক নয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কোনো পথচারীর উপর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে এর জন্য সে কতটা দায়ী সেটা নির্ভর করবে তার কতটুকু অবহেলা ছিল বা কাজটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে কি-না সেটার উপর।
একইভাবে, ইচ্ছেকৃত বংশবৃদ্ধির জন্য দায়ী করার ভিন্নতা থাকবে বিশেষ করে তারা যদি জন্মদানবিরোধের বিপরীত যুক্তি সম্পর্কে অবগত না থাকে। দোষারোপ এবং কাজটি ভালো কি-না তা মূল্যায়ণের মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। এই পন্থাটি বিভিন্ন কারণে উপকারী, বিশেষ করে আবেগের চেয়ে যৌক্তিকভাবে আলোচনার ক্ষেত্রে। যখন লোকেদের আক্রমণ করা হয় তখন বস্তুনিষ্ঠভাবে তর্কে আগ্রহী হয় না।
ধরে নিই, যারা ইচ্ছেকৃতভাবে জন্ম দেয় তাদের মধ্যে অনেকেই এই জন্মদানবিরোধ ধারণার কথা শুনেনি অথবা সেগুলি তাদের কাছে নাও পৌঁছাতে পারে।
আমরা সেই শ্রেণীর লোকেদের দোষারোপ করতে চাই না অথবা অবশ্যই বড় মাত্রার দোষ দিতে চাই না।
বরং আমরা কতটা দোষারোপ করা উচিত সেদিকে না গিয়ে বরং প্রজননের কাজটি ন্যায়সঙ্গত কি-না সেটিই যাচাই করতে চাই। এটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে একটি হলো আবেগীয় দৃষ্টিতে না দেখা।
লোকেরা যদি আক্রান্ত বোধ করে তবে তারা যুক্তিগুলি নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করতে আরো অনাগ্রহী হবে।
জন্মদানের সিদ্ধান্তের দার্শনিক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জন্মদানকে খারাপ বলার প্রয়োজন নেই ।
আমাদের জন্ম দেওয়া উচিত কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই হলো, সামাজিক রীতি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কি-না তা যাচাই করা । একটি প্রগতিশীল নৈতিকতা, মানিষের চরিত্র বা উদ্দেশ্য বিচার না করে আমাদের প্রচলিত রীতিকে পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে।
কিন্তু সমস্যা হলো যে, জীবনের গল্প বলে সবসময় জীবিতরা বা যারা টিকে থাকে। তারা সবকিছুকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন জীবনকে মূল্যবান মনে হয়।
কিন্তু তাদের সম্পর্কে কী বলবেন, যারা কখনো বলতেই পারেনি সেই ভুলে যাওয়া কিংবা অপরিচিত মুখগুলো যাদের কোনো কথা আমরা জানতে পারিনি?
সেই শিশুর কী হবে, যে জন্মের কয়েক মুহূর্ত পরই শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতায় মারা গেছে অথবা সেই শিশুটি যে মারা গিয়েছিলো মাত্র দেড় বছর বয়সে? কারণ শিশুটির মদ্যপ বাবা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিলো! অথবা সেই ছোট্ট ছেলেটি যার মা পানিতে ডুবে মারা গিয়ে শিশুটিকে স্বাধীন করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!
তার সম্পর্কে কী বলবেন, যে ২০ বছর বয়সী মেয়েটিকে অপহরণ, ধর্ষণ এবং শেষে আট টুকরো করে মুরগির মতো কেটে ফেলা হয়েছিল? যার হত্যাকারী কখনো ধরা পড়েনি!
সেই কিশোর যে আমাশয় বা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল! তার মৃত্যু ঘটেছিলো ভয়ঙ্করভাবে, রক্তাক্ত, নোংরা এবং বেদনাদায়ক উপায়ে?
সেই সমস্ত নিরীহ গরু, শূকর এবং হরিণ যাদের জীবনের শেষ পরিণতি কোনো সুপারমার্কেটের প্রদর্শনীতে বা কারো খাবারের থালায়?"
মোদ্দা কথা হলো, তারা সুখী এটা প্রমাণ করে না যে অনস্তিত্বের চেয়ে অস্তিত্ব ভালো।
আপনি হয়তো পরবর্তী সুখকে খুঁজে নিয়ে দুর্ভোগ এড়াতে পারবেন কিন্তু কখনোই অস্তিত্বে না আসার মতো কার্যকর উপায়ে পারবেন না।
যদি তারা সুখী থাকে আর যন্ত্রণা এড়াতে পারে তবে তা অবশ্যই ভালো তবে তারা জন্ম না দিয়ে আরও ভালো করতে পারত।
তাহলে তাদের হারানোর কিছুই থাকতো না।
একজন হেরোইন আসক্ত যখন পুনরায় হেরোইন গ্রহণ করে তখন সে সুখ অনুভব করে কারণ তাদের আগের আসক্তি উপশম করতে পারে কিন্তু এই বিষয়টা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না যে, কেন তারা প্রথমবার হেরোইন গ্রহণ করেছিলো।
সমস্যা হলো- অধিকাংশ মানুষ সত্যিই গভীরভাবে এই বিষয়টি চিন্তা করে না যে, তাদের এই বিশ্বাসটি অর্থাৎ তারা মারা যাওয়ার পরেও তাদের অস্তিত্ব থাকবে এবং তারপরে তারা পৃথিবীতে চলমান সুখ দেখে আফসোস করবে! এটা যদি সম্ভবও হয় তবে এই কথাও একইভাবে ত্রুটিপূর্ণ যেমনিভাবে ত্রুটিপূর্ণ যে, তারা জন্মের আগেও কিছুর জন্য আফসোস করছিলো!
তারা শুধুমাত্র তাদের জীবনের প্রতি আসক্তি সম্পর্কে জানেন তাই তারা মনে করেন যে তারা যদি অস্তিত্বে না আসতো তবে তারা আফসোস করতো।
“আমি আনন্দিত যে আমি জন্মেছি" তারা এই কথা এমনভাবে বলে যেন জন্ম না হলে খারাপ কিছু ঘটত!
তারা তাদের চাহিদা, চাওয়া, আকাঙ্ক্ষাকে তাদের অস্তিত্ব ছাড়াই এমনভাবে কল্পনা করে যেন তাদের জন্ম না হলে এই পৃথিবীতে চকলেট কেক খাওয়ার মতো কেউ থাকতো না।
"যদি আমার অস্তিত্ব না থাকত" এটা তারা এই দৃষ্টিকোণ থেকে কল্পনা করে যে তারা ইতিমধ্যে বিদ্যমান এবং তারা অনুভব করে যে তাদের অস্তিত্ব না থাকলে খারাপ লাগতো।
এছাড়াও, কিছু জীব সুখী এই বিষয়টা কিভাবে অনেক জীবের অসুখী হওয়াটাকে ন্যায্যতা দিতে পারে?
জন্ম দেওয়ার ফলে যে ভুক্তভোগী হচ্ছে তাকেই তার সুখের জন্য জন্ম দেওয়া হচ্ছে এই কথা বলা আরো অন্যায্য।
আরেকটি বিষয় হলো, জন্ম দেওয়ার সমালোচনা করা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। তার একটি কারণ হচ্ছে- তারা মনে করে যার অস্তিত্ব নেই তার জন্য সুখ পাওয়ার দরকার আছে!
জীবনকে অনেকটা ধর্ষণের সাথে তুলনা করা যায় কেননা সেখানে ধর্ষক বা ধর্ষণের পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীর যন্ত্রণার কথা ভাবেই না বরং এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চায়। অপরদিকে যে ভুক্তভোগীর জীবন ধ্বংস হয়ে যায়।
কিন্তু জন্ম দেওয়ার পক্ষে যতই যুক্তি দেওয়া হোক পৃথিবীতে প্রতিদিন কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে এবং কেউ না কেউ জীবনটা কেবল কাটিয়ে দেওয়ার জন্য মাদকের ব্যবহার করছে।
বিকল্প উত্তর
এখানে একজনের বিচার নির্ভর করে বিভিন্ন নৈতিক অন্তর্দৃষ্টির উপর।
আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, কাউকে খুশি করার জন্য কিছু লোককে অনিচ্ছাকৃত কষ্ট সহ্য করতে বাধ্য করা অন্যায়।
কিন্তু জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে এই কাজই করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কিছু শিশু জন্মের কিছুদিন পরই যন্ত্রণাদায়কভাবে মারা যাবে এবং অনেক মানুষই অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করবে।
এই লোকগুলোকে যন্ত্রণার জীবন চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় যেন অধিকতর সুখী মানুষদেরও জন্ম দেওয়া যায়!
আমাদের পৃথিবী কাল্পনিক ওমেলা সমাজের চেয়েও খারাপ।
(যেখানে সমাজের সুখ একটি শিশুর যন্ত্রণার বিনিময়ে পাওয়া যায়)
কাল্পনিক জগতে অন্য সবার সুখের জন্য একটি শিশুতে যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য করার চেয়ে বাস্তব জীবনে অনেক লোককে অন্যদের সুখের জন্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
এদের মধ্যে বড় অংশই ভাবে, তাদের যদি জন্মই না হতো! যদি আমরা অন্যান্য অনেক মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা যা অপরিমেয় কষ্ট এবং হতাশার জন্য দায়ী সেগুলোকে বিবেচনায় আনি তাহলে এটা বলার উপায় নেই যে আমরা কেবল সমাজের ছোট অংশকে নিয়ে কথা বলি যারাই কেবল অস্তিত্বহীনতাকেই চাইবে।
আত্মহত্যা একটি ভয়ঙ্কর এবং প্রায়ই বেদনাদায়ক প্রস্থানের কৌশল।
আমার মতে, ওই লোকদের বেঁচে থাকতে বাধ্য করা যাদের আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই। যে মরে যেতে চায় তাকে অন্যদের সুখের জন্য বাঁচিয়ে রাখা ওই লোকের জন্য চরম মূল্য।
কিছু লোকের জন্য, যন্ত্রণার তুলনায় অধিক আনন্দের সাথে জীবন যাপন করা হয়তো সম্ভব। কোটিপতিদের সন্তানদের হয়তো যন্ত্রণার জীবনের চেয়ে সুখী জীবনযাপনের সম্ভাবনাই বেশি কিন্তু একথা বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়।
আর এটা যদি হয়ও তবুও জীবনকে যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন এটি নেতিবাচক।
আমরা সীমাহীন চাহিদা এবং প্রয়োজন মেটানোর জন্যই বেঁচে থাকি। আমরা যে আনন্দ পাই তা আসলে কেবল আরও ভয়ানক বঞ্চনা থেকে মুক্তি।
আমরা ক্ষুধা মেটাতে খাই। একঘেয়েমি কাটাতে নিজেদের বিনোদন দেই। আমরা যন্ত্রণা ভুলতে ভ্রমে সুখ খুঁজি কিন্তু এই তৃপ্তি খুবই সাময়িক।
আর শেষ পর্যন্ত আমরা কখনো পুরোপুরি সন্তুষ্ট হই না।
চিরন্তন এই সত্যটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এই বিষয়গুলো ধনী-গরীব, সামাজিক মর্যাদা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। আর ভবিষ্যতে এমন কোনো জাদুকরী প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হবে না যা মানুষকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবে।
যদি কোনো একদিন আমরা সকল শারীরিক কষ্ট দূর করতে সক্ষমও হই তবুও আমাদের উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলার অস্থিরতা শেষ হবে না।
আপনার সন্তান আপনার মতো সৌভাগ্যবান নাও হতে পারে এটা মাথায় রেখে আপনি নতুন কাউকে জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থেকেও চরম সুখী হতে পারেন।
আপনি হয়তো এই দ্বিধায় থাকতে পারেন যে, আপনার জীবন শুরু করার মতো ছিল না তবে অকালে শেষ হয়ে যাওয়ার মতোও নয়। তবুও শেষ পর্যন্ত আপনার জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হতে পারে আর আপনি সেই দুর্দশাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হবেন। কারণ- আপনার নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ এবং সম্মানজনক, দ্রুত, যন্ত্রণাহীন এবং অব্যর্থভাবে জীবনের ইতি টানার কোনো উপায় নেই।
আপনি ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যার সুযোগ দিলেই তার উপর হওয়া অত্যাচার ন্যায্য হয়ে যাবে না।
যদি একজন লোক একটি মেয়েকে বন্দী করে রাখে এবং প্রতিদিন ধর্ষণ করে কিন্তু পাশাপাশি ওই ঘরে একটি দড়িও রাখে যেনো সে আত্মহত্যা করতে পারে তাহলেও সেটা ন্যায্য হবে না। কেননা সে ইতিমধ্যেই ভুক্তভোগীর চরম ক্ষতি করে ফেলেছে যা আত্মহত্যার সু্যোগ দেওয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া অসম্ভব। ঠিক একইভাবে জীবনবাদীরাও আমাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরে। তাদের এই যুক্তিতে যদি মেয়েটি সত্যিই ধর্ষিত হতে না চায় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে! এর ফলে সে আত্নহত্যা না করলে এটা প্রমাণিত হয় যে ধর্ষণ অবশ্যই ভালো জিনিস এবং ধর্ষণকে পুরোপুরি ন্যায্যতা প্রদান করা যায়।
যদি যাকে জন্ম দেওয়া হয়েছে সে জীবনযন্ত্রণা না চায় তাহলে সে আত্নহত্যা করবে। আত্মহত্যা না করা প্রমাণ করে যে, জীবন অবশ্যই ভালো এবং জীবন চাপিয়ে দেওয়াও ন্যায্য!
নিশ্চিতভাবেই যদি কেউ আত্মহত্যা করতে চায় তবে সে ইতিমধ্যেই ক্ষতির শিকার। কেননা তার জীবনে এমন অনেককিছুই ঘটেছে যা সে চায়নি ঘটুক। আর এজন্য দায়ী সে যে তাকে সংবেদনশীলতা দিয়েছে। এরচেয়েও হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে জীবনবাদীরা প্রজননের স্বার্থে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকারের বিরোধিতা করে।
যারা প্রজননের বিরোধিতা করে তাদের বেঁচে থাকার পেছনে বাস্তবিক কারণ রয়েছে।
যতক্ষণ আপনি অস্তিত্বে আছেন আপনি এই বার্তা (জন্মদানবিরোধের বার্তা)ছড়িয়ে দিতে পারেন এবং আত্মহত্যার চেয়েও অধিক যন্ত্রণা কমাতে পারেন। তাই এটা যৌক্তিক নয় কেউ যদি কোনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারে এবং দ্বিমত পোষণ করে তবে তাকে ওই পরিস্থিতি থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যেতে হবে।
এভাবেও দেখা যায় যে আপনাকে যুদ্ধে পাঠানোর বিষয়টা কেবল আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। vকেননা আপনি না গেলে আপনার জায়গায় অন্য কাউকে ঠিকই পাঠাবে। তাই আপনার বরং অন্য মানুষদেরকে যুদ্ধের অন্ধ সমর্থন থেকে বের করে আনা এবং যুদ্ধের ক্ষতি বা নিষ্ঠুরতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
যুদ্ধের সামগ্রিক সমস্যা কি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করলেই সমাধান হয়ে যাবে?
-তা তো নয়।
জীবনের প্রতি এক ধরনের আসক্তি কাজ করে তাই নৈতিক প্রশ্নটা হচ্ছে- কারো উপর এই আসক্তি (জীবন) চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ কি-না।
আমরা যদি জীবন ত্যাগ করতে চাই না বলে এই আসক্তিকে ক্ষতিকর বলি তাহলে ভুল বলা হবে না। যেমনিভাবে একজন ধুমপানকারী ধুমপান ছাড়তে পারছে না বলে ধুমপানকে ক্ষতিকর বলা ভুল নয়। এর অন্যথা দাবী করলে সেটা ভন্ডামি।
একজন জন্মদানকারী ব্যক্তিকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন হেরোইন আসক্ত ব্যক্তির মত বলা যেতে পারে, যে ব্যক্তি এটা স্বীকার করতে চায় না যে হেরোইন আসক্তির শুধু উপকারিতা আছে এমনটা না। আর এজন্যই তারা ভুক্তভোগীর অনুমতি ছাড়াই তার শরীরে হেরোইন প্রবেশ করায়।
একটি শিশুর জন্ম দেওয়া এই বিষয়গুলো থেকে একদম ভিন্ন। কেননা একটি অস্তিত্বহীন শিশুকে জন্ম না দেওয়া হলে সে এমন কিছু হারাবে না যে কারণে ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা শতভাগ ঝুঁকি এড়ানোকে অযৌক্তিক মনে করি। কেননা এর ফলে আমরা যন্ত্রণাই পাই। যা এড়ানোর জন্য চেষ্টা করি। যখন আমরা কিছু এড়িয়ে যাই (যেমন- গাড়ি চালানো) তখন আমরা গাড়ি না চালাতে পারার যন্ত্রণা অনুভব করি। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে গাড়ি না চালিয়েও আমরা যন্ত্রণাই পাই।
অন্যদিকে, শিশুর আত্মা চেতনা লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ অনুভব করবে না। কেননা জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত তার মা-বাবা ঝুঁকি বিবেচনা করে তাকে দুনিয়াতে আনা থেকে বঞ্চিত করেছে। শিশুটির তখন যন্ত্রণা অনুভবের অবস্থা থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বে আনার আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্ট যন্ত্রণা অস্তিত্বহীনতায় থাকা সম্ভবই না। জন্মদানকারীরাই সকল আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে।
আপনি হয়তো এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, কেউ যদি সন্তান জন্ম দিতে চায় কিন্তু না পারে তাহলে সেটা তার জন্য যন্ত্রণার। এটা অনেকটা অপরাধীর দৃষ্টিভঙ্গী যে কি-না অন্যের টাকা চুরি করে জুয়া খেলতে না পেরে যন্ত্রণা পাচ্ছে!
এখানে উল্লেখ্য যে, জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে গাড়িতে চড়ার বা রোদে বের হওয়ার ঝুঁকি আপনি নিচ্ছেন না বরং আরেকজনকে গাড়িতে বসতে অথবা রোদে যেতে বাধ্য করছেন এবং বলছেন, যাদের আপনি বাধ্য করছেন তারা মনে করবে যে, এই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক ছিলো।
যন্ত্রণা সবসময়ই নেতিবাচক। যন্ত্রণাকে ইতিবাচক বলা অনেকটা শুকনোকে ভেজা আর গরমকে ঠান্ডা বলার মতো। মাঝেমাঝে আপনাকে দুই যন্ত্রণার মধ্যে তুলনামূলক কম যন্ত্রণাকে বেছে নিতে হয়। কিংবা দুই খারাপের মাঝে কম খারাপটাকে বেছে নিতে হয়। এর মানে এই নয় যে নেতিবাচক ব্যাপারটা ভালো।
আপনি ইনজেকশন এই কারণে নিচ্ছেন না যে, ইনজেকশন নেওয়াটা ভালো। বরং আপনি ইনজেকশন নিচ্ছেন অধিকতর যন্ত্রণা এড়ানোর জন্য। ইনজেকশনের সুঁই নিজে ইতিবাচক কিছু না। ইনজেকশনের ভিতরে থাকা উপাদান আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বলেই আপনি ইনজেকশনের যন্ত্রণা সহ্য করেন।
এই সকল পরিস্থিতিতে যন্ত্রণাকে ভুলভাবে ভালো বা ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেননা এর মাধ্যমে আরও বড় যন্ত্রণা প্রতিরোধ করা যায়৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আপনি যদি একই যন্ত্রণাকে আরো কম যন্ত্রণা দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারতেন যেমন আঙুল কামড়িয়েও যদি করা যেত তবে আপনি তাই করতেন। অধিকন্তু জীবনে এমন হাজারো দুঃখ আছে যেগুলো আমাদের অধিকতর যন্ত্রণা থেকে বাঁচায় না।
অবশ্য বড় যন্ত্রণা এড়ানোর প্রসঙ্গ তখন আসবে যখন আপনি ভুক্তভোগীকে জন্ম দিবেন এবং তাকে অনুভূতিশীল করার মাধ্যমে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিবেন। জন্ম দেওয়ার ফলে যে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তাতে কোনো বড় যন্ত্রণা এড়ানোর উদ্দেশ্য থাকে না।
যে শিশুটির এখন অস্তিত্ব নেই তাকে বিভিন্নরকম অসুস্থতার যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য ইনজেকশন দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। তার অস্তিত্ব না থাকায় সে অসুস্থও হতে পারে না। তাই প্রথমেই কাউকে চেতনাশীল করে সমস্যার সূচনা করা নৈতিক নয়৷ কেননা যে জন্ম নেয়নি তাকে কোনো অধিকতর যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর কিছু নেই।
ইনজেকশন নেয়া তখনই প্রয়োজন যখন কারো অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যাদের জন্ম দেওয়া হয়নি তারা এটা ব্যাখ্যা করতে পারে না যে, শুরুতেই কেন অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে হবে। তাই একটি শিশু যৌক্তিভাবেই তার অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য মা-বাবাকে দোষারোপ করতে পারে।
জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে আপনি একটি শিশুকে অধিকতর যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে কম যন্ত্রণা বা অন্য কোনো যন্ত্রণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা এখানে অধিকতর যন্ত্রণার প্রসঙ্গই আসবে না। বরং আপনি যন্ত্রণা সৃষ্টি করছেন এবং অধিকতর যন্ত্রণার সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখছেন।
বিকল্প উত্তর-
যন্ত্রণা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপদের সংকেত হিসেবে কাজ করে। এই দৃষ্টিকোণকে আশাবাদী হিসেবে দেখা হয় কিন্তু এটা আমাদের অবস্থানের ভুল ব্যাখ্যা দেয়। আমরা অস্বীকার করছি না যে, যন্ত্রণার গুরুত্ব থাকতে পারে।
আমরা কেবল এটা বলতে চাই যন্ত্রণা সবসময়ই নেতিবাচক। যখন আমরা নতুন কাউকে অস্তিত্বে আনার কথা ভাবি তখন যন্ত্রণার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। যদি কারো অস্তিত্বই না থাকে তাহলে তার যন্ত্রণার উপকারীতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। যদি আমরা কাউকে জন্ম দিই তবে সে যে যন্ত্রণা জীবদ্দশায় ভোগ করবে তা তার জন্য নেতিবাচক। যদি ওই যন্ত্রণাগুলোর কোনো উপকারীতা থেকেও থাকে তা এই যন্ত্রণার ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
আমাদের যুক্তি হচ্ছে যন্ত্রণার গুরুত্ব থাকতে পারে কিন্তু যদি অস্তিত্বে না আনার বিকল্প থাকে তবে তার জন্য যন্ত্রণা সৃষ্টি করার কোনো গুরুত্ব নেই।
জীবনের মান যেমন হয় তার চেয়ে আপনার জীবন ভালো এমনটা আপনি যদি মনে করে থাকেন তবে এটা হয়তো অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করে ভাবছেন। তবে এর মানে এই নয় যে, আপনার মনে করাটা সঠিক। আপনার জীবনকে আপনার ধারণার মতো করে মানিয়ে নিতে হয়।
আমরা মনে করি, এসব সত্যি আর এটাও সত্যি যে মানুষ জীবনের নেতিবাচক দিকের অর্থ কী সেটা খুঁজে বেড়ায়। তারা তাদের দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যের উপকারীতা খুঁজে বেড়ায়। এটা উল্লেখযোগ্য- কেউ হয়তো প্রতিকূলতা থেকে উপকারও লাভ করতে পারে কিন্তু এটা কারো ক্ষতি বা যন্ত্রণাকে ন্যায্যতা প্রদান করে না।
ধরা যাক, একজন ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি একইরকম যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সাহায্য করার মধ্যে তার জীবনের অর্থ খুঁজে নেয়। এটা ইতিবাচক যে এর মাধ্যমে তারা সান্ত্বনা খুঁজে পায় কিন্তু এটা প্রথমেই ঘটে যাওয়া ভায়োলেন্সকে বৈধতা দেয় না। একইভাবে যখন নতুন কাউকে অস্তিত্বে আনার প্রশ্ন আসে যদি তারা জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পায় তবে সেটা ভালো কিন্তু এটা তাদের জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা প্রদান করে না।
কিন্তু যদি আমরা একটা স্বপ্নরাজ্য তৈরি করি যেখানে সবকিছুই ভালো, যেখানে অর্গাজমের মতো সুখ সবসময় বিরাজমান এবং সেখানে কোনো যন্ত্রণা নেই।
এটা তবুও একটা ব্যান্ডেজের কতোই কাজ করবে, প্রতিকার হিসেবে নয়। আনন্দ এবং যন্ত্রণা একটি অপরটির সাপেক্ষে অস্তিত্বশীল। আপনি ক্ষুধার যন্ত্রণা এবং খাবার গ্রহণের তৃপ্তি একসাথে পাবেন না। আপনার খাবার তখনই তৃপ্তির হবে যখন আপনার ক্ষুধা অধিক হবে। তাই আপনার কল্পিত রাজ্যে যদি একটানা একইরকম দুঃখবিহীন সুখ পান তবে সেটাও একঘেয়ে বা বিরক্তি লাগার যন্ত্রণা দিবে আপনাকে।
যন্ত্রণা ছাড়া সুখের অনুভূতি পরস্পরবিরোধী। এটা অনেকটা আগুন লাগা ছাড়া আগুন নেভানোর মতো কিংবা রোগ ছাড়া রোগমুক্তির মতো, জেলে না গিয়ে জেলমুক্তির আনন্দর মতো হাস্যকর! আপনার কোনো আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আগে আপনার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। আপনার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে গেলে নতুন করে অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে হবে যেন আপনি আবার আকাঙ্ক্ষা পূরণের আনন্দ পান। আপনাকে যন্ত্রণা তৈরি করতে হবে যেনো যন্ত্রণা উপশমের সুখ পান। অন্যথায় আপনি কোথা থেকে যন্ত্রণা কমানোর সুখ পাবেন?
যদি আমি কোনোভাবেই ক্ষুধার্ত না হই তাহলে কোনো খাবারই পরিপূর্ণ তৃপ্তিদায়ক হবে না।
তাই আমাদেরকে যন্ত্রণা তৈরি করা চালিয়ে যেতে হবে যন্ত্রণা থেকে উপশমের জন্য! যেটা যন্ত্রণাহীনতার মতো ভালো নয়। আর যাদের অস্তিত্ব নেই তাদের জন্য আনন্দের হিসেব কষা অর্থহীন কেননা তারা এটা থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এমন-কি ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো প্রযুক্তি তৈরি হয় যা তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলতে পারে তবুও কি আমরা একটি বনে আগুন লাগিয়ে দিবো? বনের আগুন অবশ্যই নিভানো না গেলে সেটা খারাপ তবে আগুন না লাগানো সবথেকে উত্তম।
যদি আমরা এইডস্ রোগের তাৎক্ষণিক ও কার্যকর চিকিৎসার উপায় আবিষ্কার করতেও পারি তবুও আমরা নিজের শরীরে এইডস্ এর জীবাণু প্রবেশ করাবো না যাতে আমরা এইডস্ রোগ থেকে আরোগ্য লাভের আনন্দ লাগ করতে পারি।
আর একইভাবে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে ভাবাটাও যুক্তিসঙ্গত। আমাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া এই যুক্তিতে ভালো যে তা আমাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা এসব থেকে মুক্তি দেয় কিন্তু অস্তিত্বে না আনা হলে এগুলো থেকে এমনিতেই মুক্তি পাওয়া যেতো।
কোনো আকাঙ্ক্ষা না থাকা > আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া > আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়া।
এইডস না থাকা > এইডস থেকে সুস্থ হওয়া > এইডস থেকে সুস্থ না হওয়া।
তাহলে এটাই আসল কথা যে, কোনো সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধান, সমস্যার সমাধান না হওয়ার চেয়ে ভালো।
কিন্তু কোনো সমস্যাই না থাকা সমস্যার সমাধানের চেয়ে আরো বেশি ভালো।
সমস্যা না থাকার চেয়ে উত্তম কিছু নেই। আর যন্ত্রণাহীনতাই সবচেয়ে ভালো।
যদি আমাদের লক্ষ্য হয় একটি ফুলদানি না ভাঙা তাহলে আমাদের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে ফুলদানিকে মেঝেতে না ফেলা কিন্তু মেঝেতে ফেলে আবার দাগহীন মেরামত করা নয়।
যদিও তা ভেঙে মেরামত না করতে পারার চেয়ে ভালো কিন্তু সবচেয়ে ভালো হচ্ছে এটাকে না ভাঙা।
তাই, জীবন যন্ত্রণাময় হওয়ার চেয়ে যন্ত্রণার উপশম থাকা ভালো তবে সবচেয়ে ভালো কাউকে যন্ত্রণার জীবনে না আনা।
বিকল্প উত্তর-
আরেকটি উপায় হচ্ছে এটা উপলব্ধি করা যে,
যদি আপনি জানতে পারেন আপনার সন্তান, নাতি-নাতনি এমন-কি তার পরের প্রজন্ম অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করবে কিন্তু এর পরের প্রজন্মগুলো অপরিসীম সুখ ভোগ করবে তাহলে কি আপনি সন্তানের জন্ম দেবেন? কয়েক প্রজন্মকে এর জন্য ভুগতে হবে জেনেও যাদের সম্পর্কে আপনি সরাসরি জানেনই না সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আপনি কি আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যন্ত্রণার জীবন দিবেন?
আমি মনে করি যে, এমনটা করা উচিৎ হবে না। কেননা যন্ত্রণা অতি তীব্র এবং ওই লোকদের সারাটা জীবনভর ভুগতে হবে। আপনি শুধু জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে যন্ত্রণার সূচনাই করছেন না বরং প্রচন্ড যন্ত্রণার ঝুঁকিও সৃষ্টি করছেন।
এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা যদি কল্পনা করি কোনো সমস্যা ছাড়াই সমস্যার সমাধান সম্ভব কিংবা সমস্যার সমাধান করা সমস্যার সৃষ্টিকে ন্যায্যতা দেয় তবুও তা নতুন কাউকে যন্ত্রণার জীবন দেওয়াকে বৈধতা দেয় না। কেননা তা হবে পানির পাইপ আবিষ্কারের আগে বনে আগুন দেয়ার মত কিংবা ভবিষ্যতে এইডস এর চিকিৎসা আবিষ্কার হবে আশা করে কারো শরীরে এইডস এর জীবাণু প্রবেশ করানোর মতো।
এটা একটা স্বার্থপর যুক্তি কেননা তা প্রকাশ করে যে, আপনি শিশুকে নিজের বা অন্যদের সেবার জন্য জন্ম দিচ্ছেন। এর পরিবর্তে আপনি দত্তক নিতে পারতেন কিংবা অস্তিত্বশীল কাউকে তাদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারতেন। এর মাধ্যমে কেউ তার প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারতো নতুন কারো যন্ত্রণার সৃষ্টি না করেই।
তাছাড়াও আপনার যদি পৃথিবীর মানুষকে সাহায্য করার এতোই ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনি নিজে তা না করে সন্তানের উপর নির্ভরশীল হচ্ছেন কেন?
আপনার উচিত অন্য কারো ভরসায় না থেকে নিজের সময় এবং সম্পদ পৃথিবী বদলানোর কাজে ব্যয় করা।
আগের যুগে বহু মানুষ গণহত্যা, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, মহামারি, হানাহানিতে মারা গিয়েছে। যারা টিকে থাকতে পেরেছে তারা হয়তো সৌভাগ্যবান কিন্তু বাকিরা নয়। আপনার সন্তান সৌভাগ্যবানদের একজন নাও হতে পারে। যেখানে ভুক্তভোগী আপনি নন, আপনার সন্তান হবে সেখানে আপনি জুয়াখেলার অধিকার রাখেন না। যদি ধরেও নিই আগের পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে খারাপ ছিলো তবুও এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, পরিস্থিতি আবার আগের মতো বা আগের চেয়েও খারাপ হতে পারে। এখন যন্ত্রণার পরিমাণ কম থাকার মানে এই নয় যে সেটা গ্রহণযোগ্য। কেননা যাকে জন্ম দেওয়া হবে সে এই শর্তে নাও রাজি থাকতে পারে যেখানে তার যন্ত্রণাহীন থাকার উপায় ছিলো।
আমার মতে মানুষেরা আজও আগের মতোই বা আগের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে বিভিন্ন কারণে যেমন- ঋণ, স্বল্প মজুরি, নব্য উপনিবেশবাদ, অযোগ্য নেতৃত্ব, মৌলিক স্বাধীনতাহরণ, রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, সমাজের অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পরিবেশ দূষণ, চাকরির জন্য হাহাকার ইত্যাদি।
যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য বিশ্বযুদ্ধ কিংবা গণহত্যার প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন কারণে আমরা এখনো যন্ত্রণা ভোগ করি।
উদাহরণস্বরূপ- মিলেনিয়াল প্রজন্মের অবশ্য বেবিবুমার প্রজন্মের চেয়ে অনেক কম সম্পদ আছে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে ১২০ কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে যা পৃথিবীতে তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সংকট তৈরি করবে। যেসব দেশ এই পরিস্থিতির শিকার হবে না সেসব দেশে তারা যেতে চাইবে। একই সময়ে বায়ুদূষণ, বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি, মানুষের খাদ্য এবং জ্বালানির সংকট, পানিদূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ মৃত্যুর বড় কারণ হবে। ভবিষ্যতে তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাবে, তীব্র পানি সংকট হবে, সম্পদ নিয়ে যুদ্ধ হবে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, খরার তীব্রতা, দাবানল, বন্যা এসবের ফলে জীবন আরো যন্ত্রণাদায়ক এবং কঠিন হবে।
এইসব কিছুকে বাদ দিলেও উন্নতির নেশা সবসময় মানুষকে এগিয়ে নেয় না। যদিও মানুষ মনে করে পৃথিবী ধীরেধীরে উন্নত হবে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে অবস্থার উন্নতি তো ঘটেইনি উল্টো অবনতি হয়েছে।
যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে দাসদের উন্নতির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গৃহযুদ্ধ ডেকে এনেছে। ইহুদি বিরোধিতা ভাইমার রিপাবলিকের পতন এবং হলোকাস্ট ডেকে এনেছে।
১৯৭৯ সালে ইরানের বিল্পব ইরানকে আরো রক্ষণশীল করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিল্পব দেশের শান্তি আনার পরিবর্তে অস্থিতিশীলতা, স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি করেছে। মানুষকে এখন সামন্তবাদের যুগের চেয়েও দীর্ঘসময় শ্রম দিতে হয়।
সবকিছু দিনদিন ভালো হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমাদের শিশুদের উপর এমন ঝুঁকি চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়।
ভবিষ্যতে এমনটা ঘটলে শিশুর যে দুর্ভোগ পোহাতে হবে এবং তা থেকে বাঁচতে যে সংগ্রাম করতে হবে তা না ভাবলেই নয়।
যদিও আশাবাদী হওয়া দোষের নয় তবে আমাদের নতুন কাউকে জন্ম দেওয়াকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য এটা প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। যে পরিস্থিতি এখন খারাপ সেটা ভবিষ্যতে আরো খারাপ না হয়ে ভালো হবে ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
কোনো বংশধারাই বিশেষ নয়। আপনি যদি আপনার বংশধারা এগিয়ে না নেন তাতে আপনার পূর্বপুরুষদের কিছু যায় আসে না কেননা তারা এখন বেঁচে নেই। আর হয়তো তারা বেঁচে থাকলেও আসতো যেতো না। যদি তাদের কিছু আসতো যেতোও তবুও তাদের সন্তুষ্ট করতে বা আপনার নিজের স্বার্থে সন্তান জন্ম দেওয়া অত্যন্ত স্বার্থপর কাজ। যেহেতু এর ফলে সন্তানটিকে দু্র্ভোগের সম্মুখীন করা হচ্ছে। আপনি যদি সত্যিই কোনো ইতিবাচক ছাপ রেখে যেতে চান তবে সন্তানের মাধ্যমে না করে আপনি পৃথিবীর জন্য কিছু করে সময় ব্যয় করুন। এই সম্ভাবনাও থেকে যায় যে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনার কথা মনেও করবে না। কেননা তারা তাদের দাদা বা পরদাদার পূর্বের প্রজন্ম সম্পর্কে জানেই না।
বিকল্প উত্তর-
আপনার জিনকে বিশেষ কিছু মনে করা নার্সিসিস্ট চিন্তা।
আপনার নিজের মতো আরেকজনকে জন্ম দেওয়া যাকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন তা ওই ব্যক্তির স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার করা হবে। সে কোনো পুতুল নয় যাকে নিয়ে আপনি খেলবেন। এমন-কি যদি আপনার জিন বিশেষ কিছু হয়-ও তাতেও যার অস্তিত্ব নেই সে ওই জিন না পাওয়াতে তার কিছু আসবে যাবে না।
অন্যদের উপকার করার জন্য সন্তান জন্ম দিলেও সেটা স্বার্থপরতা কারণ অন্যদের জন্য নিজের সন্তানকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। আবার এটা নিশ্চয়তা দেওয়াও সম্ভব না যে, আপনার সন্তান শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো জীবন পাবে। উপরন্তু জিন সবসময়ই ভিন্ন হয় মা-বাবা একই বংশ থেকে আসলেও।
রক্তের গ্রুপ বা জিনের ত্রুটির কারণে শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে ভ্রুণ বা শিশুর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেহেতু এসব প্রতিরোধ করার কোনো নিশ্চিত উপায় নেই তাই কোনো শিশুকে জন্মের ফল ভোগ করতে বাধ্য করা সম্পূর্ণ অনৈতিক!
তাহলে কেন কিছু লোক আত্মহত্যা করে?
আপনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে আপনার এই যুক্তির সাথে আপনার অনাগত শিশু একমত হবে? যদি তাদের জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হয় এবং তারা এটা বলতে বাধ্য হয়, যদি তাদের জন্মই না হতো!
এমনটা ঘটলে তার জন্য আপনি দায়ী। আপনি জীবন দেওয়ার আগে অনুমতি নেননি। আর অনাগতরা কখনোই এমনটা চাইবে না, কারণ যে নেই তার চাওয়াও নেই। এখন আপনার কাজের জন্য তাদের ভুগতে হবে। বস্তুত অন্যরা যে সম্পদ ব্যবহার করতে পারতো সেই সম্পদ নিজে ব্যবহার করে অন্যদের জীবনকেও দুর্দশাগ্রস্ত করতে পারে। কিংবা তাদের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত অন্যদের জীবন, সমাজ কিংবা পুরো পৃথিবীতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই যুক্তি অনুযায়ী মানুষের যত বেশি সম্ভব জন্ম দেওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকবে। যাইহোক, জীবনের মান অবশ্যই জীবনের সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অনেক খারাপ জীবনের চেয়ে একটি ভালো জীবন উত্তম। আবার একটা জীবন যে ভালো হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু যাকে জন্ম দেওয়া হচ্ছে সে কখনোই এই ঝুঁকি নেয়ার অনুমতি দেয়নি, কখনোই সুখ চায়নি যেহেতু তার অস্তিত্ব নেই। আবার সে অন্যদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সেটা পরোক্ষভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক। তাই জন্ম দেওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক।
একটি মতামত নেতিবাচক হলেই সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না। অন্যদিকে যেহেতু যন্ত্রণা অবশ্যম্ভাবী তাই এটি বাস্তব এবং কারো পক্ষে জীবনের অনুমতি দেওয়া অসম্ভব। তাই এই সিদ্ধান্ত আপনার নেওয়া উচিত নয় যেখানে অন্য কেউ জন্মের মাধ্যমে ভয়াবহ জীবন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা আপনার মতো এই ব্যাপারে ইতিবাচক নাও হতে পারে। বরং বাস্তবে তারা এটাকে খারাপ মনে করবে। এর অন্যথা বিশ্বাস করা কেবলই আশাবাদের পক্ষপাতিত্ব করা যা অন্য কারো জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। জীবন যে আসলেই খারাপ এটা উপলব্ধি করা অযৌক্তিক নয়।
যদি কেউ জানে যে যৌনমিলন থেকে গর্ভধারণ হতে পারে এবং তারপরেও প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ না নেয় এবং যদি জানে যে এটা অনৈতিক তাহলে তাদের কেবল উপভোগের জন্য অন্য একজন মানুষের ক্ষতি করা কখনোই উচিৎ নয়।
জন্মহার কমাতে উৎসাহিত করার উদ্যোগ যথেষ্ট ইতিবাচক। জোর করে নির্বিজকরণ বা গর্ভপাতকরণ নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। প্রতিটি উদ্যোগকেই এর লক্ষ্য নৈতিক অনুমোদন এবং কার্যকারিতার ভিত্তিতে মাপা উচিত। আমরা নৈতিক নিয়ম মেনে কার্যকর যে-কোনো উদ্যোগ যা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে তাকে সাদরে গ্রহণ করবো।
আমরা তা মনে করি না। গর্ভপাতকে মৃত্যুর সমর্থক হিসেবেই আমরা দেখি। একজন জন্মদানবিরোধী এটাও মনে করতে পারে গর্ভধারণ থেকেই জীবনের শুরু হয় তাই গর্ভপাত ইতিমধ্যে অস্তিত্বে আনা হয়েছে এমন কাউকে হত্যা করার মতোই!
অন্যদিকে আপনি যদি জন্মদানবিরোধের পাশাপাশি এটা বিশ্বাস করেন যে জীবন আরো পরবর্তী পর্যায় থেকে শুরু হয় তাহলে আপনার দৃষ্টিতে গর্ভপাতের মাধ্যমে কাউকে অস্তিত্বে আনা প্রতিরোধ করা হবে। মূলকথা হলো- জন্মদানবিরোধ গর্ভপাত বিষয়ে কোনো অবস্থান নেয় না বরং এটা নির্ভর করে জীবন কখন থেকে শুরু হয় এই বিশ্বাসের উপর।
বেশিরভাগ জন্মদানবিরোধীরা মনে করে কোনো শিশু প্রকৃতঅর্থে অস্তিত্বে আসে ২৮-৩০ সপ্তাহ পর কেননা বিভিন্ন প্রমাণ থেকে দেখা যায় তখনই ভ্রূণ সংবেদনশীল হয়। তাই কোনো শিশুকে অস্তিত্বে আনা প্রতিরোধ করা জন্মদানবিরোধের সাথে সংগতিপূর্ণ। যদিও সর্বোচ্চ নৈতিক উপায় হচ্ছে গর্ভধারণকে শুরুতেই প্রতিরোধ করা। তবুও সেটা গর্ভপাতের বৈধতা আছে কি-না সে ব্যাপার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও আমরা ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি যে প্রাথমিক পর্যায়েই গর্ভপাত অধিকতর নৈতিক তবুও আমরা চাই না এটা আইন করে চাপিয়ে দেওয়া হোক।
আমি মনে কর, এখানে সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নিয়ে নেওয়ার পরের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। যদি আমরা এমন একজন লোকের কথা ভাবি যে দীর্ঘস্থায়ী অসুখে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ভুগে জীবনটা চালিয়ে নিবে কি-না ভাবছে, সেখানে ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে। কেউ হয়তো মৃত্যুর চেয়ে যন্ত্রণার জীবনকে অধিক পছন্দ করবে আবার কেউ হয়তোবা দুঃসহ যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যুকে বাছাই করবে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সিদ্ধান্তের ফল তারাই ভোগ করবে তাই আমাদের উচিত হবে না নিজের চিন্তা তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া।
যাইহোক, জন্মদানের ক্ষেত্রে এই যুক্তি প্রযোজ্য হবে না। যখন নতুন কাউকে জন্ম দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে তখন আমরা চাইলেও যাকে জন্ম দেওয়া হবে তার সাথে পরামর্শ করতে পারি না। এমনটা করা অসম্ভব। ধরে নিই- আপনি এমন কাউকে তৈরি করলেন যে তাকে দাস হিসেবে তৈরি করাকে মেনে নিবে। এমন ক্ষেত্রে ঐ দাসটি যদি দাস হয়ে খুশিও থাকে তবুও তার আত্মমূল্যায়ণ তাকে দাস হিসেবে সৃষ্টি করাকে বৈধতা প্রধান করবে না। বিশেষ করে যদি তার এই আত্মমূল্যায়নের পেছনে পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া মতো কারণ বা ব্যাখ্যা দেখানো হয় তাহলে তো সেটা আরও অগ্রহণযোগ্য। তেমনি কাউকে জন্ম দিয়ে ফেলার পর সে যদি পরিস্থিতি মেনে নিয়ে জীবনকে সুখেরও মনে করে তবুও সেটা গ্রহণযোগ্য নয় এবং সেটা তাকে জন্ম দেওয়ার কাজকে বৈধতা প্রদান করে না।
আমরা দুটোই কেন করতে পারবো না?
যাইহোক, মানুষকে খারাপ মানুষের হাতে কষ্ট পাওয়া থেকে রক্ষা করার একমাত্র নিশ্চিত উপায় খারাপ মানুষটিকে জন্ম না দেওয়া। একবার যদি কাউকে অস্তিত্বশীল করা হয় তার খারাপ অবস্থা উন্নয়নে কেবল চেষ্টা করা যায়। উন্নয়নের চেষ্টা করা ভালো তবে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে প্রতিরোধ করা।
এটা স্পষ্ট যে, জন্মদানবিরোধ এবং আত্মহত্যার সমর্থনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
জন্মদানবিরোধ যদিও বলে, কাউকে অস্তিত্বে আনা মানে তাকে ক্ষতির সম্মুখীন করা তবুও মরে যাওয়া অধিকতর ভালো সেটা বলে না।
যারা জন্মদানবিরোধকে আত্মহত্যার সমর্থনে ব্যবহার করে তারা এই দুটো ধারণার পার্থক্য বুঝতে পারে না।
এমনও হতে পারে যে, বেঁচে থাকা কারো জন্য সুখের নয়। আমরা যদিও মনে করি মৃত্যু ক্ষতিকর তবে বেঁচে থাকাতেও অনেক ক্ষতি রয়েছে। এটা অনেকটা দুটো খারাপের মধ্যে কম খারাপকে বেছে নেওয়ার মতো।
মৃত্যু কখন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
জন্মদানবিরোধের ভুল ব্যাখ্যা সম্ভব। যেমনটা অন্যান্য মতবাদেরও ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। মানুষ ভুল ধারণা থেকে কিংবা ইচ্ছেকৃতভাবেও কোনো মতবাদকে বিকৃত করতে পারে। তাই শুধুমাত্র বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই একটি মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ নয়। তার পরিবর্তে ওই মতবাদের ভালো দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেটিকে মূল্যায়ন করা উচিৎ।
আমরা যদি কাউকে অস্তিত্বে আনার ব্যাপারটিকে বিবেচনায় আনি তাহলে এর ক্ষতিকর দিক সবসময়ই ভালো দিককে ছাপিয়ে যায়। একটি শিশুকে অস্তিত্বে না আনার মাধ্যমে আপনি সম্ভাব্য খারাপ এড়াতে পারেন আর সম্ভাব্য সুখ এড়ানো খারাপ নয়। তাই সংজ্ঞানুসারেই খারাপ দিক ভালোকে ছাড়িয়ে যায়। যাই-হোক এর মানে কি শুধু এই যুক্তিতেই জন্ম দেওয়া অন্যায়?
আবশ্যিক নয়, কেননা জন্ম দেওয়া শিশুটি ছাড়াও অন্যদের স্বার্থ জড়িত থাকে। এটা নির্ভর করে যাদের স্বার্থে শিশুটিকে জন্ম দেওয়া তাদের স্বার্থের তুলনায় শিশুটির জীবনে কতটুকু সুখ ও দুঃখ রয়েছে।
সুখ এবং দুঃখকে একই পাল্লায় মাপা যায় না তাই জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখ বেশি।
জীবনে এমন অনেক দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ আছে যা কয়েক বছর এমনকি জীবনভর থাকে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সুখ বলে কিছু হয় না। সুখ কেবলই কাল্পনিক ধারণা মাত্র। আপনি আঘাত কত দ্রুত পান অথচ সেই আঘাত সারতে কত দীর্ঘ সময় লাগে সেটা বিবেচনা করুন!
ভালোর সীমা যতই হোক তা খারাপকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। খারাপের কোনো সীমা হয় না।
আমরা কাউকে ৫মিনিট সর্বোচ্চ যন্ত্রণার পর ১০ কিংবা ২০ মিনিট সর্বোচ্চ সুখ দেয়ার প্রস্তাব দিলেও কোনো যুক্তিশীল মানুষই সেই প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জীবনে ভালোর চেয়ে খারাপ অনেক বেশি।
কিছুক্ষেত্রে মানুষের একটি অংশ অবশ্যই একশ বছর আগের অবস্থার চেয়ে ভালো আছে কিন্তু আধুনিকতা এবং উন্নয়নের সুবিধা সবাই সমানভাবে পায় না। অনেকেই জীবনমান উন্নয়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত এমন-কি নিপীড়ন বা বিভিন্ন কারণে তাদের অবস্থা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকেও খারাপ। এছাড়াও চিকিৎসা এবং বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত আশা করা ঠিক নয়। কেননা উন্নতির সম্ভাবনা থাকলেও ততদিনে আরো নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে।
ছোঁয়াচে রোগের উদাহরণ বিবেচনায় নিই। করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আগপর্যন্ত অনেকেরই ধারণা ছিলো যে, উন্নত পৃথিবীতে সবাই মহামারী থেকে সুরক্ষিত। এমন-কি যখন একটি সমস্যার সমাধান করা হয় তখন নতুন সমস্যা দেখা যায়। এছাড়াও উন্নত এবং অনুন্নত অঞ্চলে মানুষের মৃত্যুর কারণের ভিন্নতা থেকে অসমতা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়।
অধিকন্তু, যদি আমরা মানবজাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি তবুও এর মাঝে কাউকে জন্ম দেওয়াকে কি ন্যায্যতা প্রদান করে?
সেই সময়টির কথা কল্পনা করি যখন এনেস্থিসিয়া আবিষ্কৃত হয়নি তখন একটি দাঁত তুলতে অথবা যে-কোনো কাটাছেঁড়া বা অস্ত্রোপচার করার সময় যন্ত্রণা কমাতে কাউকে অজ্ঞান করার উপায় ছিলো না। যদি কেউ তখন বলতো যে, ভবিষ্যতে এনেস্থিসিয়ার মতো পদ্ধতি অবশ্যই আবিষ্কৃত হবে তাই সেই আশায় নতুন কাউকে অস্তিত্বে আনা যেতে পারে যে ব্যক্তি এই সমস্যার সমাধান আবিষ্কার করবে। এনেস্থিসিয়া আবিষ্কৃত হয়েছিলো ১৮৪৬ সালে তখন পর্যন্ত সব লোককেই চিকিৎসার সময় যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। আমার কাছে এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য যে, একটি শিশুকে এখন জন্ম দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া উচিৎ কি-না এই আশায় যে, আগামী হাজার বছর পরে আমরা যে যন্ত্রণা ভোগ করছি তার সমাধান আবিষ্কৃত হবে?
এটা স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে সবারই ভুল হয় আর সবাই এমন অনেক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে যেসবে জড়ানো তার উচিত নয়। ভুলের উর্ধ্বে কেউই না, সবারই সীমাবদ্ধতা ও দুর্বল দিক আছে। তাই যখন কোনো কাজ ভুল নাকি সঠিক যাচাই করা হয় তখন সেটা কেবল ঐ কাজের উপর নির্ভর করেই সততার সাথে করা উচিত। এই মূল্যায়ন হওয়া উচিত ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে। যাচাই করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কাউকে উত্তম বা অধম করে না!
এটা একদমই মিথ্যা, কেননা আমরা এখন পর্যন্ত যা বলে আসছি তার সবই বাস্তবতা, কেবল আমাদের মতামত নয়। যদিও যারা দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা অন্যদের তুলনায় তাড়াতাড়ি বাস্তবতা বুঝতে পারে। জন্মদানবিরোধ হতাশাবাদী নয় বরং যারা এর বিরোধিতা করে আশাবাদিতা তাদের অন্ধ করে ফেলেছে। আর তারা পলিয়ানা নীতির শিকার; যে নীতি অনুযায়ী মানুষ দুর্ভোগ এড়াতে খারাপ স্মৃতি ভুলে যায় ও ভালো স্মৃতি মনে রাখে। অন্যদিকে, নিহিলিজম বলে কিছুরই কোনো মূল্য নেই, ভালো-খারাপ, সুখ-দুঃখ এসব ধারণা মানুষের সৃষ্টি, মানুষের অস্তিত্বে মহাবিশ্বের কিছু যায় আসে না!
এটা স্পষ্ট যে, জন্মদানবিরোধ এবং আত্মহত্যার সমর্থনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
জন্মদানবিরোধ যদিও বলে, কাউকে অস্তিত্বে আনা মানে তাকে ক্ষতির সম্মুখীন করা তবুও মরে যাওয়া অধিকতর ভালো সেটা বলে না।
যারা জন্মদানবিরোধকে আত্মহত্যার সমর্থনে ব্যবহার করে তারা এই দুটো ধারণার পার্থক্য বুঝতে পারে না।
এমনও হতে পারে যে, বেঁচে থাকা কারো জন্য সুখের নয়। আমরা যদিও মনে করি মৃত্যু ক্ষতিকর তবে বেঁচে থাকাতেও অনেক ক্ষতি রয়েছে। এটা অনেকটা দুটো খারাপের মধ্যে কম খারাপকে বেছে নেওয়ার মতো।
মৃত্যু কখন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
জন্মদানবিরোধের ভুল ব্যাখ্যা সম্ভব। যেমনটা অন্যান্য মতবাদেরও ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। মানুষ ভুল ধারণা থেকে কিংবা ইচ্ছেকৃতভাবেও কোনো মতবাদকে বিকৃত করতে পারে। তাই শুধুমাত্র বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই একটি মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ নয়। তার পরিবর্তে ওই মতবাদের ভালো দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেটিকে মূল্যায়ন করা উচিৎ।
অনেকেই আমাদের অবস্থানকে নিহিলিস্টিক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে কিন্তু আমরা নিজেদের নিহিলিস্ট মনে করি না। আমরা দুর্ভোগকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি এবং সেজন্যই একটি শিশুকে জন্ম দেয়া হলে সে নিশ্চিতভাবেই দুর্ভোগ পোহাবে এই ভাবনা থেকে জন্মদানের বিরোধিতা করি। অন্যদিকে, নিহিলিজম বলে কোনো কিছুরই মূল্য নেই, ভালো-খারাপ, সুখ-দুঃখ এসব ধারণা মানুষের সৃষ্টি, মানুষের অস্তিত্ব থাকা না থাকায় মহাবিশ্বের কিছু আসে যায় না! আমাদের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন, আমরা দুর্ভোগ প্রতিরোধ করতে চাই এবং কারো সাথে অনৈতিক অন্যায় না ঘটুক সেটা নিশ্চিত করতে চাই।
যদিও আমাদের জীবনের মহাজাগতিক অর্থের ব্যাপারে আমরা কিছুটা নিহিলিস্ট কেননা আমরা মনে করি আমাদের অস্তিত্বের কোনো মহাজাগতিক তাৎপর্য নেই।
আপনার সন্তান আপনার মতো সৌভাগ্যবান নাও হতে পারে এটা মাথায় রেখে আপনি নতুন কাউকে জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থেকেও চরম সুখী হতে পারেন।
আপনি হয়তো এই দ্বিধায় থাকতে পারেন যে, আপনার জীবন শুরু করার মতো ছিল না তবে অকালে শেষ হয়ে যাওয়ার মতোও নয়। তবুও শেষ পর্যন্ত আপনার জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হতে পারে আর আপনি সেই দুর্দশাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হবেন। কারণ- আপনার নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ এবং সম্মানজনক, দ্রুত, যন্ত্রণাহীন এবং অব্যর্থভাবে জীবনের ইতি টানার কোনো উপায় নেই।
আপনি ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যার সুযোগ দিলেই তার উপর হওয়া অত্যাচার ন্যায্য হয়ে যাবে না।
যদি একজন লোক একটি মেয়েকে বন্দী করে রাখে এবং প্রতিদিন ধর্ষণ করে কিন্তু পাশাপাশি ওই ঘরে একটি দড়িও রাখে যেনো সে আত্মহত্যা করতে পারে তাহলেও সেটা ন্যায্য হবে না। কেননা সে ইতিমধ্যেই ভুক্তভোগীর চরম ক্ষতি করে ফেলেছে যা আত্মহত্যার সু্যোগ দেওয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া অসম্ভব। ঠিক একইভাবে জীবনবাদীরাও আমাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরে। তাদের এই যুক্তিতে যদি মেয়েটি সত্যিই ধর্ষিত হতে না চায় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে! এর ফলে সে আত্নহত্যা না করলে এটা প্রমাণিত হয় যে ধর্ষণ অবশ্যই ভালো জিনিস এবং ধর্ষণকে পুরোপুরি ন্যায্যতা প্রদান করা যায়।
যদি যাকে জন্ম দেওয়া হয়েছে সে জীবনযন্ত্রণা না চায় তাহলে সে আত্নহত্যা করবে। আত্মহত্যা না করা প্রমাণ করে যে, জীবন অবশ্যই ভালো এবং জীবন চাপিয়ে দেওয়াও ন্যায্য!
নিশ্চিতভাবেই যদি কেউ আত্মহত্যা করতে চায় তবে সে ইতিমধ্যেই ক্ষতির শিকার। কেননা তার জীবনে এমন অনেককিছুই ঘটেছে যা সে চায়নি ঘটুক। আর এজন্য দায়ী সে যে তাকে সংবেদনশীলতা দিয়েছে। এরচেয়েও হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে জীবনবাদীরা প্রজননের স্বার্থে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকারের বিরোধিতা করে।
যারা প্রজননের বিরোধিতা করে তাদের বেঁচে থাকার পেছনে বাস্তবিক কারণ রয়েছে।
যতক্ষণ আপনি অস্তিত্বে আছেন আপনি এই বার্তা (জন্মদানবিরোধের বার্তা)ছড়িয়ে দিতে পারেন এবং আত্মহত্যার চেয়েও অধিক যন্ত্রণা কমাতে পারেন। তাই এটা যৌক্তিক নয় কেউ যদি কোনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারে এবং দ্বিমত পোষণ করে তবে তাকে ওই পরিস্থিতি থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যেতে হবে।
এভাবেও দেখা যায় যে আপনাকে যুদ্ধে পাঠানোর বিষয়টা কেবল আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। vকেননা আপনি না গেলে আপনার জায়গায় অন্য কাউকে ঠিকই পাঠাবে। তাই আপনার বরং অন্য মানুষদেরকে যুদ্ধের অন্ধ সমর্থন থেকে বের করে আনা এবং যুদ্ধের ক্ষতি বা নিষ্ঠুরতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
যুদ্ধের সামগ্রিক সমস্যা কি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করলেই সমাধান হয়ে যাবে?
-তা তো নয়।
জীবনের প্রতি এক ধরনের আসক্তি কাজ করে তাই নৈতিক প্রশ্নটা হচ্ছে- কারো উপর এই আসক্তি (জীবন) চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ কি-না।
আমরা যদি জীবন ত্যাগ করতে চাই না বলে এই আসক্তিকে ক্ষতিকর বলি তাহলে ভুল বলা হবে না। যেমনিভাবে একজন ধুমপানকারী ধুমপান ছাড়তে পারছে না বলে ধুমপানকে ক্ষতিকর বলা ভুল নয়। এর অন্যথা দাবী করলে সেটা ভন্ডামি।
একজন জন্মদানকারী ব্যক্তিকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন হেরোইন আসক্ত ব্যক্তির মত বলা যেতে পারে, যে ব্যক্তি এটা স্বীকার করতে চায় না যে হেরোইন আসক্তির শুধু উপকারিতা আছে এমনটা না। আর এজন্যই তারা ভুক্তভোগীর অনুমতি ছাড়াই তার শরীরে হেরোইন প্রবেশ করায়।
এমন কোনো বিশ্বাস নেই যা বংশগতির মাধ্যমে ছড়ায়! বিভিন্ন ধারণা জানা এবং অভিজ্ঞতাই বিশ্বাসকে বেশি প্রভাবিত করে। নাহলে তো কোনো জন্মদানবিরোধীই থাকতো না কেননা আমাদের মা-বাবা ও পূর্বপুরুষেরা জন্মদানবিরোধী ছিলো না বলেই তো আমাদের জন্ম হয়েছে! বংশগতির চেয়েও পারিপার্শ্বিকতা একজন ব্যক্তির বিশ্বাসে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। বংশগতির ভূমিকা অবশ্যই আছে, তবে এটাই একমাত্র প্রভাবক নয়। তাহলে বিষমকামী মা-বাবার সন্তান কীভাবে সমকামী হয়? আমরা উত্তম তাই আমাদের সন্তান নেওয়া উচিত এটা তো একরকম সুপ্রজননবিদ্যার মতো বর্ণবাদী ধারণা।
আমরা যা করি তার সবকিছুই জৈবিক। এমন-কি হত্যা এবং ধর্ষণও।
মানুষকে যদি হত্যা এবং ধর্ষণ না করতে উৎসাহিত করা হয় সেটা কি ভুল বা অন্যায় হবে?
উপরন্তু, অসংখ্য লোক সন্তান জন্ম দেয় না। আবার অনেক লোক যাদের সন্তান আছে সেটাও কেবলই অপরিকল্পিত দূর্ঘটনার ফল যার পেছনে কাজ করে যৌনতার জৈবিক তাড়না। প্রজননের তাড়না নয়।
এটা সত্যি যে কিছু পুরুষ এবং নারীর সন্তান নেওয়ার প্রতি আগ্রহ আছে তবে আগ্রহ থাকা মানেই অধিকার নয়। কেননা অনেক সময় একজন রাগান্বিত ব্যক্তির আপনাকে খুন করার আগ্রহ জাগতে পারে। যারা জৈবিক বলে যুক্তি দেয় তারা মনে করে, আমাদের মেনে নেওয়া উচিৎ যে, আমরা কেবলই বানরগোত্রীয় প্রাণী। আর আমাদের এর থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা উচিৎ নয় বরং আলিঙ্গন করা উচিৎ!
এটা জয়ী হওয়ার ব্যাপার নয় এবং জয় বলে কিছু হয়ও না।
মতান্তরিত করা বোকা ধার্মিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আমরা কেবল একই মানসিকতা লোকদের স্বাগত জানাতে পারি। তাদের অনুভূতিগুলোকে মূল্যায়ন করতে পারি এবং তাদের দেখাতে পারি যে তারা একা নয়।
আমরা ইতিমধ্যেই জয়ী। কেননা আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ক্ষতি এবং দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিলো তা আমাদের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে।
জন্মদানের বিপক্ষে এতো যুক্তি শোনার পরেও অনেকে জন্ম দিবে। অন্যরা জন্ম দিবে কেননা তারা এসব যুক্তি শুনতে পায়নি এবং জন্ম নিরোধক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। কিছু লোকের অবশ্য রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে জন্মদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই থাকে না।
অনেকেই মনে করেন মানুষের বিলুপ্তি খারাপ জিনিস কিন্তু বিষয়টি বিতর্কিত। মানুষ ধ্বংসাত্মক, ভয়ানক প্রজাতি যারা অন্য মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর। বিপরীতে বিলুপ্তি কারো জন্যই খারাপ নয়। তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আমাদের প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটা খারাপ হবে না।
যদি আমরা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলও হই তবুও আমাদের জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থাকা মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর হবে না। বস্তুত এমন অনেক প্রমাণ আছে যে ভবিষ্যতে মানবজাতি অধিক জনসংখ্যার জন্য পানি এবং জ্বালানির সীমাবদ্ধতায় ভুগতে হবে।
যদি আপনি মনে করেন যে জন্মদানবিরোধ দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নয় (যদিও আমি জানতে চাই কী কারণে) তবুও আপনি এই মুহূর্তে সন্তান জন্ম দেওয়াকে ন্যায্যতা দিতে পারবেন না। কেননা তাদের জন্ম দেওয়া হলে তারা পৃথিবীর সম্পদ নিঃশেষের জন্য ভূমিকা রাখবে। আপনার সন্তান হয়তো অন্যদের সাথে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করবে অথবা অন্যদের অধিকার অস্বীকার করবে। তাই দার্শনিক দৃষ্টিকোণ যাই বলুক না কেন আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের সন্তান জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত। বিশেষত যখন আপনি বুঝতে পারেন, মানুষ এত দ্রুত জন্ম দিচ্ছে সেখানে আপনার ভূমিকা না রাখলেও চলবে।
আমরা যদি সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তাহলে আমরা ছাড়া কারো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং আমাদের সম্ভাব্য সন্তানের অস্তিত্বে আসা থেকে বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই কেননা তার অস্তিত্ব না থাকায় তার বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আমরা শুধুমাত্র তাদের অসুখী হওয়ার কিংবা তাদের দ্বারা অন্য প্রাণীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যেতে চাই।
আমরা বরং সন্তান না নিয়ে আফসোস করবো এবং কিছুটা একাকী এবং অপূর্ণতা অনুভব করবো সন্তান জন্ম দিয়ে তাদেরকে দুর্ভোগে ফেললাম এটা নিয়ে আফসোস করার চেয়ে।
আমরা বরং সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ না করে অন্য কোনোভাবে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করবো।
সন্তান জন্ম দেওয়া এমন একটি কাজ যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী তৈরি হচ্ছে। যদিও অনেক মানুষ অস্তিত্বকে পছন্দ করে তবুও তারা জন্ম না নিলে কিছু যেতো আসতো না।
জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থাকা এমন একটি কাজ যেখানে আমরা নিজেরা ছাড়া কেউ-ই ভুক্তভোগী হবে না। আমরা অন্য কাউকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে বরং স্বেচ্ছায় কিছুটা দুর্ভোগ পোহাবো যেন আমরা মারা যাওয়ার পর কোনো ভুক্তভোগী রেখে যেতে না হয়।
জন্মদানবিরোধ এক ধরনের নেতিবাচক উপযোগবাদ; যার মানে হলো এটা কেবল দুর্ভোগ কমানোর দিকে গুরুত্ব দেয়।
সাধারণত মানুষ কারো উপর কিছু চাপানোর ক্ষেত্রে অনুমতির উপর গুরুত্ব প্রদান করে। আর যেখানে অনুমতি নেওয়ার উপায় থাকে না সেখানে সবথেকে উত্তম হলো বোঝাটা না চাপানো। আমাদের কাজের দ্বারা যেন অন্য কারো ক্ষতি না হয় সেটা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু একইভাবে কাউকে সুখ দেওয়ার কোনো দায় আমাদের নেই। যেমন- যদিও এটা সুন্দর ব্যাপার কিন্তু আমাদের নিজের টাকা অন্যদের দিয়ে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু অবশ্যই অন্যের টাকা চুরি করা উচিৎ নয়। কিন্তু জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে এই নীতি ভঙ্গ করা হয়। কেননা যাকে জন্ম দেওয়া হচ্ছে সে এটা নাও স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারে যদিও জন্ম হয়ে গেলে তার আর বিকল্প থাকে না।
নেতিবাচক উপযোগবাদ সর্বোচ্চ সুখ লাভের ইতিবাচক উপযোগবাদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। এখন এবং সম্ভবত সবসময় মানুষের অভিজ্ঞতা দুর্ভোগের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সন্তান জন্ম না দিয়ে আমরা দুর্ভোগ প্রতিরোধ করতে পারি। সর্বোচ্চ সুখ লাভের চেয়ে সফল কোনো উপায় নেই। কাউকে অস্তিত্বে না আনলে কেউ-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
জন্মদানকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গুরুত্বপূর্ণ যখন আমরা বুঝতে পারি একটি শিশুকে অস্তিত্বে আনলে যথেষ্ট ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য ক্ষতি এর সাথে জড়িত থাকে।
যখন কেউ সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা স্বার্থপর কিছু কারণের জন্যই নেয়।
যেমন- তাদের নাম, সম্পত্তি কিংবা জিনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই সন্তানকে ব্যবহার করে।
যাইহোক, এইভাবে শিশুটিকে বস্তু হিসেবে বা পিতা-মাতার স্বার্থ পূরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সন্তানকে সন্তানের স্বার্থে জন্ম দেওয়া হয় না।
উপরন্তু, জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষের উপর অনুমতি ছাড়াই জীবন চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে অবশ্যম্ভাবী দুর্ভোগ এবং অস্তিত্বের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হয়। কারো উপর জীবন চাপিয়ে দেওয়া নৈতিক নয়। বিশেষত শিশুটির জীবন যত ভালো হবে কল্পনা করা হয়েছিলো ততটা ভালো না হয়৷ যদি কেউ জন্ম দেওয়ার নৈতিক অধিকারের পক্ষে কথা বলে তবে সেটা অবশ্যই জন্ম দেওয়ার ফলে শিশুটির যে ক্ষতি হবে এবং তৃতীয় পক্ষরা এই সিদ্ধান্তের কারণে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।
যারা মা-বাবা হওয়ার আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নিতে চায় তাদের জন্য দত্তক নেওয়া একটু সুন্দর বিকল্প হতে পারে যেখানে জন্ম দেওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি নেই। ভালোবাসাপূর্ণ একটি ঘর প্রয়োজন এমন একটি শিশু যে ইতিমধ্যে অস্তিত্বশীল তাকে দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে যে-কেউ মা-বাবা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নতুন কাউকে জন্ম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়াই।
পৃথিবীর প্রতি অবদান রাখা সত্ত্বেও আমাদের জন্মদানবিরোধীদের ভুল বোঝা হয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তো কোনো অবদান রাখছি না তবুও আমাদের দর্শন এবং প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে।
আমরা অস্তিত্বশীলদের প্রতি ভালোবাসা ছড়াতে চাই, যন্ত্রণা কমাতে চাই এবং যারা আছে তাদের জীবনমানের উন্নতি করতে চাই। কাউকে জন্ম দেওয়ার পরিবর্তে দত্তক নেওয়াকে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে যাদের ভালোবাসা এবং সহায়তা দরকার তাদের যত্ন নেওয়াকে আমরা উৎসাহিত করি। এইভাবে নতুন কাউকে অস্তিত্বশীল করার পরিবর্তে বিদ্যমান অস্তিত্বশীলদের কল্যাণে কাজ করে আমরা একটি ভালোবাসাময় সমাজ গড়তে অবদান রাখি।
জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে সফলতা এবং পূর্ণতা লাভের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীকে আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন করতে চাই। অর্থপূর্ণ জীবনের জন্য কাউকে অবশ্যই জন্ম দিতে হবে এমন ধারণার পরিবর্তে আমরা ব্যক্তিগত উন্নয়ন, সৃজনশীলতা এবং সমাজসেবায় অবদানের মতো বিকল্প রাখতে চাই।
যদিও আমরা জন্মদানবিরোধীরা পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছি না কিন্তু আমাদের প্রচারণা নৈতিকতা ভালোবাসা এবং অস্তিত্বশীলদের কল্যানে অবদান রাখছে।
আমরা জন্ম দেওয়ার বিরোধীতা করি উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ব্যক্তিগত দুঃখ, আমাদের বেড়ে ওঠা কিংবা মা-বাবার সাথে আমাদের সম্পর্কের প্রভাব এতে নেই। তার পরিবর্তে অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত দুর্ভোগ এবং সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনায় নিয়েই জন্ম দেওয়ার বিরোধীতা করা হয়। কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির জন্মের সাথে এর সম্পর্ক নেই।
যদিও কিছু মানুষের তার মা-বাবার সাথে ব্যক্তিগত সমস্যা থাকতে পারে। এর মানে এই নয় যে, পুরো জন্মদানবিরোধী আন্দোলন এর ভিত্তিতে হচ্ছে। আমরা প্রজননের নৈতিক দিককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত আরো ভেবেচিন্তে নেওয়ার আহ্বান জানাই।
জন্মদানবিরোধকে কারো ব্যক্তিগত ক্ষোভের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা এর দার্শনিক এবং নৈতিক যুক্তিগুলোকে খাটো করে দেখা হয়।
এর ফলে নতুন কাউকে পৃথিবীতে আনার নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের অর্থপূর্ণ আলোচনা এবং উদ্বেগকে অস্বীকার করা হয়।
জন্মদানবিরোধী হিসেবে আমরা মনে করি এইসব অভিযোগ আমাদের বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্যকে ভুল ব্যাখ্যার ফলে তৈরি হয়েছে।
সুপ্রজননবিদ্যা, ফ্যাসিবাদ এবং গনহত্যা এসবের উদ্দেশ্য থাকে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ন্ত্রণ বা ধ্বংস করে দেওয়া। অন্যদিকে জন্মদানবিরোধ হচ্ছে সেই দার্শনিক অবস্থান যা প্রজননের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং স্বেচ্ছায় জন্মহার কমানোকে উৎসাহিত করে।
যদিও কেউ কেউ ভুলবশত জন্মদানবিরোধকে সুপ্রজননবিদ্যা কিংবা ফ্যাসিবাদের সাথে গুলিয়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট করা আবশ্যক যে, জন্মদানবিরোধ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লোকেদের প্রতি বৈষম্যকে উৎসাহিত করে না।
জন্মদানবিরোধ প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নতুন কাউকে আনার আগে এর নৈতিকতা বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে। কারো উপর বিশ্বাস বা কোনো কাজ চাপিয়ে দেওয়াকে সমর্থন করে না।
গনহত্যার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। গনহত্যা হচ্ছে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস করে দেওয়া বা শেষ করে দেওয়া। কিন্তু জন্মদানবিরোধের দার্শনিক অবস্থান এর থেকে ভিন্ন। জন্মদানবিরোধীরা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে না বরং বিশ্বজুড়ে প্রজননের নৈতিকতা ও প্রভাব নিয়ে আলোচনাকে উৎসাহিত করে।
জীবনের একটি অংশ সত্যিই কষ্টের যেমন ক্যান্সার, পঙ্গুত্ব ও দুর্যোগ। যদিও জীবন সূর্যাস্ত, চকলেট আইসক্রিম আর অর্গাজমের মতো সুন্দর অভিজ্ঞতাও উপহার দেয়। অনেকেই যুক্তি দেয় যে এই ভালো ব্যাপারগুলো খারাপ ব্যাপারগুলোকে ন্যায্যতা প্রদান করে। চলুন আমরা এ যুক্তিটি আরও গভীরভাবে যাচাই করে দেখি।
যখন থেকে আপনি সংবেদনশীল তখন থেকে আপনাকে অবশ্যই ভালো অনুভূতিগুলো পেতে হবে যাতে আপনি খারাপ অনুভূতিগুলো এড়াতে পারেন। অস্তিত্বে আসার আগে ভালো বা খারাপের অনুভূতি ছিলো না কেননা তখন সংবেদনশীলতাই ছিলো না। তাই যতক্ষণ আমরা কাউকে অস্তিত্বে না আনি ততক্ষণ ভালোর অনুপস্থিতি কোনো সমস্যাই নয়।
মৌলিক প্রয়োজন বিবেচনায় নিলে:
আপনি না খেলে ক্ষুধার্ত হবেন।
আপনি পান না করলে তৃষ্ণার্ত হবেন।
আপনি যদি মলত্যাগ না করেন, আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হবে।
আপনি যদি অর্গাজম না করেন, আপনি উত্তেজনা অনুভব করবেন।
এভাবে ভালো কিছু পাওয়ার মাধ্যমে আপনি অধিকতর খারাপ কিছু থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছেন। কিন্তু আপনার জন্মই না হলে যতটা কার্যকরভাবে সব খারাপ থেকে বাঁচতে পারতেন সেটা অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আমরা কোনো জীবকে সংবেদনশীল করার মাধ্যমে তার উপকার করি এই ধারণাটি ত্রুটিপূর্ণ। অস্তিত্বশীল হওয়ার পূর্বে তার খারাপ অনুভূতি এড়ানোর জন্য ভালো অনুভূতি লাভের আবশ্যকতা ছিলো না কেননা তখন তার অস্তিত্বই ছিলো না। একবার সে অস্তিত্বশীল হলে তার খারাপ অনুভূতি এড়ানোর জন্য ভালো অনুভূতি পাওয়া লাগবেই। এটা অনেকটা রোগের উপশমের জন্য নতুন করে রোগ তৈরির মতোই।
তাই আপনি যখন একটি শিশুকে তার ভালো হবে ভেবে অস্তিত্বে আনেন, আপনি আসলে সমস্যা সমাধানের জন্য একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছেন। এটা তেমনই অযৌক্তিক যেমন অযৌক্তিক আগুন নেভানোর জন্য একটি ঘরে আগুন দেয়া, কাউকে এইডস রোগের চিকিৎসা দেয়ার জন্য তার শরীরে এইডসের ভাইরাস দেয়া কিংবা কাউকে ব্যান্ডেজ ও পেইনকিলার দেয়ার জন্য তার পা ভেঙে দেয়া বা বুকে চুরিকাঘাত করা। আপনি এখানে যন্ত্রণা দূর করার জন্য প্রথমে যন্ত্রণা তৈরি করছেন।
আমি যদি আপনার ঘরে আগুন না লাগাই তাহলে তো আপনার সেটা নেভানোর প্রয়োজনই হবে না। তাই এমনটা যুক্তি দেয়া একদমই উদ্ভট যে আপনি খারাপ কিছু (ঘরে আগুন) সৃষ্টি করে তা দূর করার মাধ্যমে ভালো কিছু অর্জন করছেন কেননা সেই ভালোটা আপনার দুর্ভোগের সাপেক্ষে আসে।
আপনার খাওয়ার ইচ্ছা যদি একেবারে চলে যায় তাহলে খাবার আপনাকে আর আনন্দ দিবে না। খাওয়ার ইচ্ছাকে আপনি রুচি বলুন আর ক্ষুধা, ক্ষুধা কষ্টের কিন্তু ক্ষুধার পরিবর্তে যদি রুচিও হয় সেটাও যন্ত্রণার। আপনাকে যদি আপনার পছন্দের খাবার কখনওই খেতে দেয়া না হয় তাহলে সেটা আপনার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করবে, যে অস্বস্তি অতোটা তীব্র নয় কিংবা দৈনন্দিন জীবনে দৃষ্টিগ্রাহ্যও নয়।
যদি অপূর্ণ চাহিদা ইতোমধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে সেটা পূরণ করা ভালো বলে বিবেচিত হবে। তবে অপূর্ণ চাহিদা নতুন করে তৈরি করা ভালো বলে বিবেচিত হবে না। তেমনটা করলে আপনি একটি শিশুকে অভাব ও খারাপ অবস্থায় পতিত করছেন। এটা একটি ঘরকে পুড়তে দেখা বা একটি শিশুকে সাগরে ডুবতে দেখারর মতো। যদিও আগুন নেভানো বা শিশুটিকে বাঁচানো ভালো কাজ তবে এর জন্য প্রথমে ঘরে আগুন দেয়া বা শিশুটিকে সাগরে নিক্ষেপ করা ভালো কাজ নয়। আপনি তাহলে কেবলমাত্র সমস্যা নতুন করে তৈরি করছেন!
সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, সমস্যার উপশম হবেই এমনটা সুনিশ্চিত নয়। যারা জন্ম দেয় তারা কখনোই নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে জন্ম দেওয়া শিশুটির জীবনের সকল চাহিদা পূরণ হবে। চাহিদা বা অভাব কতটা যন্ত্রণা দিবে, চাহিদা পূরণের আনন্দ কতটা স্থায়ী হবে কিংবা অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া আদৌ এসব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব কি না এসবের নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা একটি চাহিদার যন্ত্র (শিশু) তৈরি করে।
অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায় আবার অনেক চাহিদাই অন্যের ক্ষতির বিনিময়ে পূরণ হয়।
যদি আমরা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলও হই তবুও আমাদের জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থাকা মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর হবে না। বস্তুত এমন অনেক প্রমাণ আছে যে ভবিষ্যতে মানবজাতি অধিক জনসংখ্যার জন্য পানি এবং জ্বালানির সীমাবদ্ধতায় ভুগতে হবে।
যদি আপনি মনে করেন যে জন্মদানবিরোধ দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নয় (যদিও আমি জানতে চাই কী কারণে) তবুও আপনি এই মুহূর্তে সন্তান জন্ম দেওয়াকে ন্যায্যতা দিতে পারবেন না। কেননা তাদের জন্ম দেওয়া হলে তারা পৃথিবীর সম্পদ নিঃশেষের জন্য ভূমিকা রাখবে। আপনার সন্তান হয়তো অন্যদের সাথে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করবে অথবা অন্যদের অধিকার অস্বীকার করবে। তাই দার্শনিক দৃষ্টিকোণ যাই বলুক না কেন আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের সন্তান জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত। বিশেষত যখন আপনি বুঝতে পারেন, মানুষ এত দ্রুত জন্ম দিচ্ছে সেখানে আপনার ভূমিকা না রাখলেও চলবে।
আমরা যদি সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তাহলে আমরা ছাড়া কারো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং আমাদের সম্ভাব্য সন্তানের অস্তিত্বে আসা থেকে বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই কেননা তার অস্তিত্ব না থাকায় তার বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আমরা শুধুমাত্র তাদের অসুখী হওয়ার কিংবা তাদের দ্বারা অন্য প্রাণীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যেতে চাই।
আমরা বরং সন্তান না নিয়ে আফসোস করবো এবং কিছুটা একাকী এবং অপূর্ণতা অনুভব করবো সন্তান জন্ম দিয়ে তাদেরকে দুর্ভোগে ফেললাম এটা নিয়ে আফসোস করার চেয়ে।
আমরা বরং সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ না করে অন্য কোনোভাবে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করবো।
সন্তান জন্ম দেওয়া এমন একটি কাজ যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী তৈরি হচ্ছে। যদিও অনেক মানুষ অস্তিত্বকে পছন্দ করে তবুও তারা জন্ম না নিলে কিছু যেতো আসতো না।
জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থাকা এমন একটি কাজ যেখানে আমরা নিজেরা ছাড়া কেউ-ই ভুক্তভোগী হবে না। আমরা অন্য কাউকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে বরং স্বেচ্ছায় কিছুটা দুর্ভোগ পোহাবো যেন আমরা মারা যাওয়ার পর কোনো ভুক্তভোগী রেখে যেতে না হয়।
জন্মদানবিরোধ এক ধরনের নেতিবাচক উপযোগবাদ; যার মানে হলো এটা কেবল দুর্ভোগ কমানোর দিকে গুরুত্ব দেয়।
সাধারণত মানুষ কারো উপর কিছু চাপানোর ক্ষেত্রে অনুমতির উপর গুরুত্ব প্রদান করে। আর যেখানে অনুমতি নেওয়ার উপায় থাকে না সেখানে সবথেকে উত্তম হলো বোঝাটা না চাপানো। আমাদের কাজের দ্বারা যেন অন্য কারো ক্ষতি না হয় সেটা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু একইভাবে কাউকে সুখ দেওয়ার কোনো দায় আমাদের নেই। যেমন- যদিও এটা সুন্দর ব্যাপার কিন্তু আমাদের নিজের টাকা অন্যদের দিয়ে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু অবশ্যই অন্যের টাকা চুরি করা উচিৎ নয়। কিন্তু জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে এই নীতি ভঙ্গ করা হয়। কেননা যাকে জন্ম দেওয়া হচ্ছে সে এটা নাও স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারে যদিও জন্ম হয়ে গেলে তার আর বিকল্প থাকে না।
নেতিবাচক উপযোগবাদ সর্বোচ্চ সুখ লাভের ইতিবাচক উপযোগবাদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। এখন এবং সম্ভবত সবসময় মানুষের অভিজ্ঞতা দুর্ভোগের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সন্তান জন্ম না দিয়ে আমরা দুর্ভোগ প্রতিরোধ করতে পারি। সর্বোচ্চ সুখ লাভের চেয়ে সফল কোনো উপায় নেই। কাউকে অস্তিত্বে না আনলে কেউ-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
আপনার সন্তান আপনার মতো সৌভাগ্যবান নাও হতে পারে এটা মাথায় রেখে আপনি নতুন কাউকে জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থেকেও চরম সুখী হতে পারেন।
আপনি হয়তো এই দ্বিধায় থাকতে পারেন যে, আপনার জীবন শুরু করার মতো ছিল না তবে অকালে শেষ হয়ে যাওয়ার মতোও নয়। তবুও শেষ পর্যন্ত আপনার জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হতে পারে আর আপনি সেই দুর্দশাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হবেন। কারণ- আপনার নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ এবং সম্মানজনক, দ্রুত, যন্ত্রণাহীন এবং অব্যর্থভাবে জীবনের ইতি টানার কোনো উপায় নেই।
আপনি ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যার সুযোগ দিলেই তার উপর হওয়া অত্যাচার ন্যায্য হয়ে যাবে না।
যদি একজন লোক একটি মেয়েকে বন্দী করে রাখে এবং প্রতিদিন ধর্ষণ করে কিন্তু পাশাপাশি ওই ঘরে একটি দড়িও রাখে যেনো সে আত্মহত্যা করতে পারে তাহলেও সেটা ন্যায্য হবে না। কেননা সে ইতিমধ্যেই ভুক্তভোগীর চরম ক্ষতি করে ফেলেছে যা আত্মহত্যার সু্যোগ দেওয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া অসম্ভব। ঠিক একইভাবে জীবনবাদীরাও আমাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরে। তাদের এই যুক্তিতে যদি মেয়েটি সত্যিই ধর্ষিত হতে না চায় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে! এর ফলে সে আত্নহত্যা না করলে এটা প্রমাণিত হয় যে ধর্ষণ অবশ্যই ভালো জিনিস এবং ধর্ষণকে পুরোপুরি ন্যায্যতা প্রদান করা যায়।
যদি যাকে জন্ম দেওয়া হয়েছে সে জীবনযন্ত্রণা না চায় তাহলে সে আত্নহত্যা করবে। আত্মহত্যা না করা প্রমাণ করে যে, জীবন অবশ্যই ভালো এবং জীবন চাপিয়ে দেওয়াও ন্যায্য!
নিশ্চিতভাবেই যদি কেউ আত্মহত্যা করতে চায় তবে সে ইতিমধ্যেই ক্ষতির শিকার। কেননা তার জীবনে এমন অনেককিছুই ঘটেছে যা সে চায়নি ঘটুক। আর এজন্য দায়ী সে যে তাকে সংবেদনশীলতা দিয়েছে। এরচেয়েও হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে জীবনবাদীরা প্রজননের স্বার্থে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকারের বিরোধিতা করে।
যারা প্রজননের বিরোধিতা করে তাদের বেঁচে থাকার পেছনে বাস্তবিক কারণ রয়েছে।
যতক্ষণ আপনি অস্তিত্বে আছেন আপনি এই বার্তা (জন্মদানবিরোধের বার্তা)ছড়িয়ে দিতে পারেন এবং আত্মহত্যার চেয়েও অধিক যন্ত্রণা কমাতে পারেন। তাই এটা যৌক্তিক নয় কেউ যদি কোনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারে এবং দ্বিমত পোষণ করে তবে তাকে ওই পরিস্থিতি থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যেতে হবে।
এভাবেও দেখা যায় যে আপনাকে যুদ্ধে পাঠানোর বিষয়টা কেবল আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। vকেননা আপনি না গেলে আপনার জায়গায় অন্য কাউকে ঠিকই পাঠাবে। তাই আপনার বরং অন্য মানুষদেরকে যুদ্ধের অন্ধ সমর্থন থেকে বের করে আনা এবং যুদ্ধের ক্ষতি বা নিষ্ঠুরতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
যুদ্ধের সামগ্রিক সমস্যা কি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করলেই সমাধান হয়ে যাবে?
-তা তো নয়।
জীবনের প্রতি এক ধরনের আসক্তি কাজ করে তাই নৈতিক প্রশ্নটা হচ্ছে- কারো উপর এই আসক্তি (জীবন) চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ কি-না।
আমরা যদি জীবন ত্যাগ করতে চাই না বলে এই আসক্তিকে ক্ষতিকর বলি তাহলে ভুল বলা হবে না। যেমনিভাবে একজন ধুমপানকারী ধুমপান ছাড়তে পারছে না বলে ধুমপানকে ক্ষতিকর বলা ভুল নয়। এর অন্যথা দাবী করলে সেটা ভন্ডামি।
একজন জন্মদানকারী ব্যক্তিকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন হেরোইন আসক্ত ব্যক্তির মত বলা যেতে পারে, যে ব্যক্তি এটা স্বীকার করতে চায় না যে হেরোইন আসক্তির শুধু উপকারিতা আছে এমনটা না। আর এজন্যই তারা ভুক্তভোগীর অনুমতি ছাড়াই তার শরীরে হেরোইন প্রবেশ করায়।
